Tuesday, 29 May 2018

আকবর-বীরবল এর দুটি গল্প

এক কড়ি থেকে লক্ষ মুদ্রা
--আকবর-বীরবল


একটি বালক একজন ভিখিরিকে এক কড়া কড়ি একদিন ভিক্ষা দিল। টিফিনের জন্য পাওয়া কড়ি থেকে সে গরিব দুঃখীকে ভিক্ষে দিল টিফিনের জন্য খরচ না করে।
      মাত্র এক কড়া, দেখে ভিখিরি রেগে সেটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।
     বালকটি তাকে ডেকে বলল, ‘এক কড়াকে এমন তুচ্ছ করছ কেন ভাই? দেখো, মা বাবাদের মুখে শুনেছি, এ অঞ্চলেরই একজন লোক মাত্র এক কড়া করে কড়ি ভিক্ষে করে এক লক্ষ মুদ্রা সঞ্চয় করেছিল। যত ক্ষুদ্রই হােক অর্থকে তুচ্ছ করতে নেই। আজ যদিও ফেলে দিয়েছ, কাল থেকে তুমি ফেলে দিও না ভাই; যার যা সামর্থ্য সে তো তাই দেবে। এতে তোমার রাগ করার কী আছে?


      কড়ির মূল্য ভিখিরি কতটা বুঝল, কে জানে! .



আতঙ্কের ফল

গ্রামের একটি ছেলে আঙুরখেতে ঢুকেছিল আঙুর চুরি করার জন্য।
     সে আঙুর খেতে বড় ভালবাসে। এখানে এই বাগানে কিন্তু কেবল ভাল জাতের আঙুর ফল পাওয়া যায়।
    ক্ষেতের মালিক দূর থেকে দেখতে পেয়ে হাঁক দিলেন, ‘এই কে রে? কী করছিস ওখানে? এদিকে আয় আমার সামনে।’
      ছেলেটি ঘাবড়ে গিয়ে বলল,‘আজ্ঞে ইয়ে ভীষণ পায়খানা পেয়েছিল, তাই পায়খানা করতে এসেছিলাম। ইয়ে—মানে আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি।’
     মালিক এগিয়ে এসে বললেন, ‘কই! কোথায় পায়খানা করছিলি দেখি? এখানে তো পায়খানা করার জায়গা নয়?”
     সামনে কিছু গোবর পড়ে ছিল। ছেলেটি সেই গোবর দেখিয়ে দিয়ে বলল, “ওই তো, ওখানে পায়খানা করেছি।’
     মালিক বললেন, ওগুলো—মানে, ও তো গরুর গোবর! মানুষের পায়খানা নয় তো!’
    ছেলেটি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,‘আমি পায়খানা করতে বসা মাত্র দূর থেকে আপনি হাক দিলেন, “কে-রে?” শুনে আতঙ্কে আমার পেটের পিলে চমকে ওঠাতেই বোধ হয় পায়খানা গোবরের মতো হয়ে গেছে। আপনার গলার আওয়াজ যার কানে যাবে সেই এমন পায়খানা করে ফেলবে।

Thanks for visiting my Blog.

Labels:

Saturday, 26 May 2018

পরলোকের হাঁড়ির খবর

পরলোকের হাঁড়ির খবর 
            - আশাপূর্ণা দেবী

লম্বা সাঁকোটার এপারে একপাশ ঘেষে দাঁড়িয়েছিল বটকেষ্ট। সময় পেলেই এরকম দাঁড়িয়ে থাকে সে। সাঁকোটা দিয়ে মানুষ পারাপার দেখে। এটা বটকেষ্টর একটা নেশা। কে আসছে কে যাচ্ছে, কে চেনা কে অচেনা তার হিসেব রাখা।
      তা সাঁকো পারাপার তো করছে সবাই। হরদম। দিনদুপুর নেই, রাতদুপুর নেই, সকাল নেই, সন্ধে নেই। এই যে মাত্র খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে বটকেষ্ট, কতক্ষণ তা অবশ্য জানে না, হাতে তো ঘড়ি বাঁধা নেই কাজেই সময়ের হিসেবও নেই। তবে খুব বেশিক্ষণ নয়। এইটুকুর মধ্যেই কতজন এল গেল। আজ আর চেনা জানা কাউকে দেখল না। আর সবাই তো ঝড়ের বেগে ছুটছে, দাঁড়িয়ে একটা কথা বলবে, এমন সময় নেই।
      যারা যায় তাদের তো কথাই নেই, দৌড়োনোর ঘটা কী? যেন ট্রেন ফেল হয়ে যাচ্ছে, না রাজ্য হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। যারা আসে, তারা বরং কখনো কখনো একটু দাঁড়িয়ে বটকেষ্টর কাছে খোঁজতল্লাশ নেয়, কতদিন এখানে আছে বটকেষ্ট, জায়গাটা কেমন, এইসব।

      আজ আর তেমন কাউকে পায়নি। কথা বলতে না পেয়ে পেট ফুলছিল বটকেষ্টর। হঠাৎ দেখতে পেল ওই দূরে, সাঁকোটার একেবারে ওমাথায় কে যেন আসছে, হাঁটার ভঙ্গিটা যেন চেনা চেনা। দৈবক্রমে এ-সময় সাঁকোটা একটু ফাঁকা রয়েছে। বটকেষ্ট চোখের ওপর দিকে হাত আড়াল করে নিরীক্ষণ করে দেখতে চেষ্টা করল লোকটা কে!
      নদীটা বিশাল, সাঁকোটাও বিশাল লম্বা। পার হয়ে আসতে সময় লাগে। ধৈর্য ধরে থাকতে থাকতেই লোকটা কাছাকাছি এসে গেল। চিনতে পারল বটকেষ্ট। আর চিনে চমকে গেল!
      গজগোবিন্দ না? ও না মিলিটারির চাকরি নিয়ে জলন্ধরে না কোথায় চলে গিয়েছিল। তাগড়া জোয়ান চেহারা, এক কথাতেই চাকরি হয়ে গিয়েছিল। অবিশ্যি যুদ্ধ করার চাকরি নয়। গজগোবিন্দ হচ্ছে ডাক্তার, সেই চাকরিই পেয়েছিল মিলিটারিতে। তো এক্ষুনি চলে এল মানে?
      ভাবতে ভাবতেই লোকটা, মানে গজগোবিন্দ একদম সামনে এসে গেল, আর চেঁচিয়ে উঠল, কেঁ বঁটা নাঁ?
     বটকেষ্ট শিউরে উঠল। চমকাল খানিকটা আহ্লাদে, খানিকটা দুঃখে। বলল, তুঁইও চঁলে এঁলি? তাঁ তোঁ এঁলুম। যঁমের মুঁখে থাঁকা তোঁ? কিন্তু তুঁই কঁবে? 
      সেঁই তোঁ উঁল্টোরথের দিন। 
      তুঁই দেঁশে নাঁ থাঁকাতেই আঁমার এঁই বিঁপত্তি। তোঁর ওঁষুদ একদাঁগ পঁড়লেঁই ঠিক সেঁরে যেঁতুম।
      গজগোবিন্দ বলে উঠল, হঁয়েছিঁল কী? 
     আঁর বঁলিস ক্যাঁনো! ওঁই উঁল্টোরঁথের মেঁলা দেঁখতে গিঁয়ে খাঁন আঁষ্টেক পাঁপড় ভাঁজা আঁর দুঁ’কুঁড়ি মাত্তর বেঁগুনি-ফুঁলুরি খেঁয়েছিঁলুম। ব্যঁস। হঁয়ে গেঁল। ব্যাঁটা নিৰ্ঘত কেঁরোসিঁনে পাঁপড় ভেঁজেছিল।
      গজগোবিন্দ হো হো করে হেসে বলে উঠল, তুঁই দেখছি এঁকরঁকমই রঁয়ে গেঁলি। মেলার বাঁজারের পাঁপড়ভাঁজা দেঁখলে আঁর কাঁণ্ডজ্ঞাঁন থাকে না।
      হাসতে হাসতে আহ্লাদের চোটে গজগোবিন্দ ভীমের গদার মতো দুখানা হাত মেলে জড়িয়ে ধরল বটকেষ্টকে। সঙ্গে সঙ্গে বটকেষ্টও তার লিকলিকে হাত দুটো বাড়িয়ে জাপটে ধরল গজুকে। তা ফল দুজনের একই হল।
      ‘খুস’ করে একটু হাওয়া খেলে গেল দুজনের মধ্যে। দুজনেই তো একটু হাওয়াই জাপটে ধরেছে। সাঁকো দিয়ে হুড়মুড়িয়ে অনেকগুলো লোক চলে এল। বটকেষ্ট আর গজগোবিন্দর ওপর দিয়ে বয়ে গেল। ধাক্কা অবিশ্যি লাগল না, তবে একটা ডিসটার্বেনস তো বটে।
      বটকেষ্ট বলল, চঁ গঁজু, আঁমার ওঁখানে। নিঁরিবিঁলিতে। 
     গজগোবিন্দ তাজ্জব হয়ে বলল, অ্যাঁ। এঁখেনে তোঁর নিঁজেস্বো ঘঁরবাঁড়ি আঁছে?
     বটকেষ্ট একটু রহস্যময় হাসি হেসে বলল, ‘আঁছে বঁললে আঁছে, নাঁই বঁললে নাঁই। তোঁ নিঁরিবিঁলিটা আঁছে। নবকেঁষ্টর মা তোঁ সেঁখানের। পৃঁথিবীর বাঁড়িতে।
      গজগোবিন্দ একটু দুঃখিত হয়ে বলল, ওঁ। তাঁই তোঁ! আঁহা। তুঁই আঁসার আঁগে খুঁব কাঁন্নাকাঁটি কঁরল তোঁর গিন্নী?
     তাঁ করছিল। শুঁনতে শুঁনতে চঁলে এঁইচি। বহুদূঁর অঁবধি সেঁই চেঁচানির আঁওয়াজ কাঁনে এঁসেছে। 
     দুজনে আসতে লাগল। তবে হাঁটার কষ্ট তো নেই। হাওয়ায় ভাসা ব্যাপার। অনেকখানিটা দূরে চলে এসে বটকেষ্ট বলল, আঁয়।
      গজগোবিন্দ অবাক হয়ে বলল, এঁই বাঁড়িটা আঁগে দেঁখেঁছি মনে হঁচ্ছে। 
    তাঁ হঁতেই পাঁরে। এঁটা আমার বঁর্ধমানের দেঁশের বাঁড়িটার প্যাটানের। ওঁখানে যাঁরা ভঁদ্দর হঁয়ে কাঁটিয়ে এঁসেছে তাঁদেরকে এঁমনটা দেঁওয়া হঁয়। গুঁড কনডাঁকটের প্রাঁইজ আঁর কি!
      কিছু গাছপালার পাশ দিয়ে দরজায় চলে এল বটকেষ্ট বন্ধুকে নিয়ে। 
[বিঃ দ্রঃ—দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, প্রেসের ভাঁড়ারে চন্দ্রবিন্দু অক্ষরটির শর্ট পড়ে যাওয়ায়, এদের কথোপকথনে আর চন্দ্রবিন্দু দেওয়া সম্ভব হবে না।]
      গজগোবিন্দ কলেজে পাঠকালে একবার বটকেষ্টর দেশের বাড়িতে গিয়েছিল। এখন দেখে অবাক হয়ে গেল, ঠিক যেমন যেমন দেখেছিল সেই রকমই ব্যবস্থা। উঠোনে কুয়ো, কুয়োয় কপিকল লাগানো, পাশে ঘটি-বালতি।
      দাওয়ার ধারে একখানা বড় চৌকি আর খান দুই-তিন জলচৌকি পাতা। অর্থাৎ এটাই ড্রইংরুম। বটকেষ্ট বলল, হাত-মুখ ধুবি? 

      গজগোবিন্দ বলল, নাঃ। আসার আগে এইসা চান করিয়েছে, সর্দি হয়ে গেছে। বসি আয়। 
      চৌকিটায় বসল দুজনে। 
     বটকেষ্ট বলল, খাবি কিছু? 
     গজগোবিন্দ বলল, তা পেলে মন্দ হয় না। 
     কী খাবি বল? 
     কী আছে তোর? 
     কিছুই নেই, আবার সবই আছে যা চাইবি, পেয়ে যাবি। 
     গজগোবিন্দ যোশ হয়ে বসে বলল, ব্যাপারটা কী বল তো? 
    ব্যাপারটা এইই। যা চাই মনে করবি, সামনে এসে যাবে। তবে— 
    একটু দুঃখু দুঃখু আর মজা মজা হাসি হাসল বটকেষ্ট। 
    কী হল রে বটা? তবে’ বলে হাসলি যে? 
    বটকেষ্ট বলল, হাসছি এই জন্যে খেলে তুই টের পাবি না। খাচ্ছিস, খেলি। 
    অ্যাঁ। 
    সেই তো। এই যে তখন তোতে-আমাতে কোলাকুলি হল। হাতে-বুকে টের পেয়েছিলি কিছু? 
    গজগোবিন্দ আস্তে মাথা নাড়ল।
    হুঁ। ঠিক সেই রকমই। দেখ হাতে হাতেই। তা তুই তো মিষ্টির যম ছিলি, মিষ্টিরই অর্ডার দিই?
    তাই দে।
   বটকেষ্ট হাতটা একবার উঁচু করে হাতছানি দেওয়ার মতো ভঙ্গিতে বলল, এই যে শুনছেন? বড় এক থালায় নবীনের রসগোল্লা গাঙ্গুরামের চমচম গিরিশের কড়াপাক কল্পতরুর অমৃতি আর তিতু ময়রার রসমালাই পাঠিয়ে দিন তো। বেশ বড় সাইজের থালা নেবেন। আর সব জিনিস চারটে চারটে দেবেন।
    গজ বলল, ইয়ে বট, চিত্ৰকূট হবে না? আমাদের ঝামাপুকুর লেনের মোড়ে হলধরের দোকানে যে পেল্লায় সাইজের চিত্ৰকূট বানাত? অবিশ্যি দামটা একটু বেশি। বোধহয় দুটাকা করে। তবে কী ফাস্ট ক্লাশ ।
     দামের জন্যে ভাবতে হবে না।
     গলাটা একটু চড়িয়ে বলল বটকেষ্ট, ঝামাপুকুর লেনের হলধরের দোকানের চিত্ৰকূট চারখানা।
     গজগোবিন্দ বলল, সবাই চারখানা করে বলছিস, তুই খাবি না?
     আমার মিষ্টি খাওয়া বারণ জানিস না? ডায়াবেটিস।
    গজ অবাক হয়ে বলল, এখনো, এখানে এসেও আছে সে সব?
    থাকবে না? জানিস না স্বভাব যায় না মলে?
    বাঃ, এটা কী স্বভাব? এটা তো রোগ!
    ও দুই এক। দেখিস এই রোগ নিয়েই আবার জন্মাতে যাব।
    ধ্যেৎ
   ধ্যেৎ মানে? দেখিসনি কেউ কেউ জন্ম পেটরোগা, কেউ কেউ জন্ম থেকেই লোহা খেয়ে হজম করে। কারুর বা জন্মকাল থেকেই বারোমাস কান কটকট মাথা ঝনঝন নাকে সর্দি। কারুর ওসবের বালাই মাত্র নেই। মানেটা কী?
   মানে বলবার আগেই চোখের সামনে চৌকির ওপর এসে পড়ল বৃহৎ একখানা খাগড়াই কাসার থালা! তাতে পরিপাটি করে সাজানো অর্ডারি-মালগুলি।
    গজগোবিন্দর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
    বলল, কতকাল যে এসব জিনিস চোখে দেখিনি রে। মিলিটারিতে তো রুটি আর মাংস, ডাল আর চাপাটি ছাড়া কিছুই নেই। কিন্তু তুই একেবারে খাবি না? একলা খাব?

বটকেষ্ট হেসে বলল, খাব না বলে অর্ডার দিইনি। তবে দে দু-একটা।
    গজ বিপন্নভাবে বলল, দেবই বা কোথা থেকে? যা গুনেগুনে আনালি। তো যাকগে, ডায়াবেটিসের রুগি মিষ্টি না খাওয়াই ভালো। আমিই হা হা হা গপগপ লপালপ! এ কী, আরে কী হল? গেল কোথায় খাবারগুলো?
     তোর পেটের মধ্যে।
    ধ্যাৎ কখন? খেলাম কই?
    গপাগপ মুখে পুরলি না?
    গজ মনমরা ভাবে বলল, পুরলাম, তাই না? কিন্তু জিভ জানতে পারল কই?
    পায় না !
    বটকেষ্ট বলল, ওই দুঃখে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। শুধু হাওয়া খেয়ে থাকি। কী হবে মিথ্যে ঋণের বোঝা বাড়িয়ে?
    ঋণের বোঝা মানে? এসব ধার করে নিলি না কি?
    বটকেষ্ট হেসে বলল, তবে? এই ধার করে রাখলাম, পরের জন্মে শোধ করতে হবে!
   গজগোবিন্দ এখানে নবাগত, এপারের হালচাল কিছু জানে না। অবাক হয়ে বলল, পরের জন্মে? কি করে শোধ করবি? এইসব দোকান থাকবে?
    থাকবে না আবার? পরের জেনারেশান কি দোকানে মিষ্টি খাওয়া ছাড়বে? তার পরের জেনারেশান?
    গজ বলল, কিন্তু এখনকার লোকগুলো কী বেঁচে থাকবে তোর ধার শোধ নিতে?
    আরে সে তো নিশ্চয় থাকবে না। তবে ওর নাতি-পুতি গিন্নি-পুণ্য কেউ তো থাকবেই, তাদের দেব।
    গজর হাঁ বেড়ে যাচ্ছে। তারা তোকে চিনতে পারবে?
   চিনবে না। তবে না পারলেও কিছু এসে যাবে না। একজন্মের পাওনাদার সাতজন্ম পিছনে ধাওয়া করে ফেরে। আদায় না করে ছাড়ে না।
    বটা!
    কী?
    তুই এত শিখলি কী করে?
    এই লোকমুখে শুনে শুনে। সবাই তাদের এক্সপিরিয়েন্সের ফল শোনাতে ব্যস্ত।
    গজগোবিন্দ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে হঠাৎ বলে উঠল, এটাই তাহলে পরলোক? আমরা মরে গেছি?
    শুনে হোহো করে হেসে উঠল বটকেষ্ট।
    এতক্ষণে বুঝলি? দশবছর মিলিটারিতে থেকে তোর বুদ্ধি-সুদ্ধি ভোতা মেরে গেছে।
    গজগোবিন্দ বলল, তাই হবে। তবে চল তোর এই পরলোকটা একটু বেড়িয়ে দেখি।
   দূর! কোনো চার্ম নেই। সবই তো মরা। বাগান-টাগানগুলোয় সেই যে কোন কালে ফুল-ফল ধরে আছে, সে আর ঝরেও না, শুকোয়ও না। নদীতে বান ডাকে না, পাহাড়ে ধস নামে না। শহরে লোডশেডিং হয় না, বর্ষায় রাস্তায় জল জমে না, কোথাও কোনো কলকব্জা বিগড়োয় না, জামাজুতো ছেড়ে না—
     গজ উল্লাসে লাফিয়ে উঠে বলে, আরে সাবাস! এ যে দারুণ সুখের জায়গা রে।
     দু-দশদিন থাক, বুঝবি ঠ্যালা। সুখে অরুচি ধরে যাবে। তার চে’ তুই সেখানের গপ্পো বল সদ্য এলি। সদ্যই দেখে এলি!
    গজগোবিন্দ হতাশ হয়ে বলল, ওখানের আর কী গল্প! মরছি তা টের পেয়েছি? কোথায় কোনখানে একটা বোমা পড়ল, ধারে-কাছেই নয়। শব্দে বুকটা কেমন ধড়মড়িয়ে উঠল, জ্ঞান হারিয়ে গেল। কে জানে কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম। জ্ঞান ফিরলে দেখলাম, চেনা জগৎটা কোথায় হারিয়ে গেছে; মস্ত একটা নদী, তাতে লম্বা সাঁকো। বোকার মতো সেই সাঁকোর মুখে দাঁড়িয়ে আছি।.তারপরই হঠাৎ তোকে দেখে যেন বেঁচে গেলাম।
      বটকেষ্ট আবার হেসে অস্থির।
     বেঁচেই গেলি বটে। তো পৃথিবীর জন্যে মন কেমন করছে না তোর? যেতে ইচ্ছে করছে না?
    করছে রে, খুব করছে। হঠাৎ আচমকা চলে আসতে হল! বৌ-ছেলেমেয়েকে লিখেছিলাম সামনের মাসে ছুটি নিয়ে বাড়ি আসছি। হল না। তারা খুবই মনোকষ্টে আছে তো? একটিবার যদি ঘুরে আসতে পারতাম!

    বটকেষ্ট বলে ওঠে, ঘুরে আসা যায়। তবে ভাবছিস তারা তাহলে আহ্লাদে ভাসবে, কেমন? ওই আনন্দেই থাকো। যাও না। গিয়ে দ্যাখোগে। গেলে দেখেই আঁ আঁ করে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করবে, ওঝা ডাকবে, ভূত ছাড়ানোর মন্তর পড়ে বাড়িতে সর্ষে পড়া ছড়াবে, দরজায় দরজায় আমনাম লিখে রাখবে।
কে বলেছে তোকে এসব?
     গজগোবিন্দ তার ভীমের গদার মতো হাতের থাবাটা দিয়ে চৌকিতে একটা ঘুষি মারল। শব্দটব্দ হল না, শুধু ঘুষিটা উঠে এল হুস করে।
     বটকেষ্ট বলল, বলেছে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা। আমার যে গিন্নি আমার চলে আসার কালে ডাক ছেড়ে কেঁদে কেঁদে বলছিল, তোমায় না দেখে আমি কী করে থাকবো গো--কী করে বাঁচবো গো’—তিনিই যেই না ভরসন্ধ্যায় বাইরের জানলায় আমায় একটু দেখেছেন, সেই বিকট চিৎকার করতে করতে সে ঘর ছেড়ে চম্পট। ছেলেটার পড়ার ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম, ছেলে বলে উঠল, “বাবা! প্লিজ। দয়া করে তুমি আমাদের মায়া ত্যাগ করো’...বলেই ফটাফট ঘরের তিন তিনটে আলো জ্বেলে দিয়ে চেঁচিয়ে নামতা পড়া শুরু করে দিল, ‘আম দুই সাড়ে তিন! অমাবস্যে ঘোড়ার ডিম।
      শুনে গজ তো হাঁ।
      হঠাৎ এটা বলতে বসল কেন?
      বুঝছিস না? ইয়াংম্যান। ফুটবলে চ্যাম্পিয়ান। প্রত্যক্ষে ‘আম’নাম করতে লজ্জা! তাই ওই কান ঘুরিয়ে নাকে হাত।
      গজ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তাহলে বলছিস গিয়ে কোনো লাভ নেই।
      লাভ ওই অভিজ্ঞতা। যতক্ষণ তুমি মানুষ, ততক্ষণ সবাই তোমার আপন’, যেই তুমি ভূত’ কেউ তোমার নয়।
     কী? আমরা এখন ভূত ?
     গজ মিলিটারি মেজাজে চড়ে উঠল।
     বটকেষ্ট বলল, 'ভূত' বলতে দুঃখু হয়, বলতে পারিস প্রেতাত্মা।
     গজগোবিন্দ হতাশ গলায় বলল, নাঃ। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। একটু ঘুমিয়ে নিই। দারুণ ঘুম পাচ্ছে।
     বটকেষ্ট লবডঙ্কা নেড়ে বলল, ওই ‘পাবে’। হবে না।
     হবে না ?
    না। এখানে নিদ্রাজাগরণ বলে কিছু নেই। কিম্ভূতকিমাকার একটা অবস্থা রে গজু। ক্ষিধের জ্বালা নেই,—খাওয়ার সুখ নেই। রোগ-ব্যাধির যন্ত্রণা নেই, আবার সুস্থ স্বাস্থ্যের আরামও নেই। দেহ আছে দেহ নেই।
    গজগোবিন্দ বলে উঠল—ক্ষিধের জ্বালা নেই সেটা তো একটা শান্তি রে বটু। ক্ষিধের জ্বালার বাড়া তো দুঃখ নেই।
    কী যে বলিস গজু! ক্ষিধের জ্বালা না থাকলে, খাওয়ার সুখটা পাবি? যেটা জীবনের সবচে’ সুখ।
    তাহলে—
    তাহলে বলে কিছু বলতে যাচ্ছিল গজু, হঠাৎ একটা কেলে কুচ্ছিৎ খ্যাঁকশেয়ালিমুখো লোক এসে দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল, এই যে গজগোবিন্দ ডাক্তার কে?
    এই তো।
    নিজের বুকে হাত চাপড়াল গজ। মানে ভাবল হাতটা চাপড়েছে।
    লোকটা বলল, তা এসেছ তো অনেকক্ষণ, এতক্ষণ ফ্রেন্ডের সঙ্গে আড্ডা মারা হচ্ছে যে ! ডিউটি দিতে হবে না?
    ডিউটি।
    গজ মিলিটারি। চড়ে উঠে বলল, এখানে আবার ডিউটি কিসের?
    অ্যাঁ ডিউটি নাই? ওরে আমার চাঁদুরে। গরমেন্টের রাজত্বে বাস করবে, ডিউটি দিতে হবে না?
    গজ চেঁচিয়ে বলল, বটা। ঠিক?
    বটকেষ্ট বলল, খুব ঠিক রে ভাই!
    তো কাজটা কী ?
    লোকটা বলল, কী তা গিয়েই দেখতে পাবে। পৃথিবীতে যে যা করেছে, করত, এখানেও তাই করতে হবে। ধোবাকে রাতদিন ধোবার পাটে কাপড় কাচতে হবে, নাপতেকে রাতদিন লোকের গোঁপদাড়ি চাঁচতে হবে। কুমোরকে রাতদিন চাক ঘোরাতে হবে। কলুকে রাতদিন ঘানি ঘোরাতে হবে। কামারকে রাতদিন লোহা পেটাতে হবে। ছুতোরকে—
    বুঝলাম। গজগোবিন্দ বলে উঠল। আর আমাকে?
    তোমাকে?
    লোকটা মিচকে হাসি হেসে বলল, তোমায় দিনভোর রুগির নাড়ি টিপতে হবে।
    তো এখানে তো রোগ-ব্যাধিই নেই শুনলাম।
    নাইবা থাকল। তা বলে ডিউটি ফাঁকি দেবে নাকি? বলি ভূতের ব্যাগার খাটা’ বলে কথা শোনো নাই কখনো? ভুতো খাটুনি? এই যে তোমার বন্ধুবাবু, রেল কোম্পানির মালবাবু ছিল না? তো ওনার ডিউটি রাতদিন মাল ওজন আর তার হিসেব রাখা। তবে লোকটা মহা ফাঁকিবাজ। একদণ্ডে কাজ সেরে ওই নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকে।
    ও, ওই যেখান দিয়ে এলাম? বিশাল নদী! তো নদীটার নাম কী হে?
   লোকটা নিজের কপাল চাপড়ে বলল, হায় কপাল। তাও বোঝোনি? বেশি পণ্ডিতদের এই হয়। বৈতরণী গো। বৈতরণী।
    ‘অ্যাঁ’
    গজ যেন নতুন করে শক খেল, বৈতরণী পার হয়ে চলে এসেছি তার মানে সত্যি মারা গেছি? সত্যি ভূত হয়ে গেছি!
    লোকটা হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে গজকে ধাক্কা দিয়ে বলল, চল চল। প্রেথমে "স্বরূপ ঘরে’ ধোলাই হবে চল। তবেই টের পাবে।
    গজগোবিন্দ মুখ ফিরিয়ে বলল, স্বরূপ ঘর’ কী রে বটা? কী হয় সেখানে?
    বটকেষ্ট হঠাৎ মিচকি হেসে বলল, এই যে এই হয়। আঁ আঁ আঁ আঁক করে ছুট মারল গজগোবিন্দ।
    ‘স্বরূপ ঘরে ধোলাই-এর’ পরে কী হয়?
    আসল চেহারাটি হয়।

    মুলো মুলো দাঁত, কুলো কুলো কান, উল্টো উল্টো পা, জটা জটা চুল, আর কেলে কম্বুলে গায়ের রং।
ধোলাই একবার হতেই হবে, মেকআপটাও নিতে হবে। তবে সেটা প্রকাশ করা তোমার ইচ্ছে সাপেক্ষ ।
    লোকটার সঙ্গে যেতে যেতে গজগোবিন্দ বলল, আমার থাকার জায়গাটা কোথায়?
    কেন, হসপিটাল এরিয়ায়।
    লোকটার একটু ইংরিজি বুলি প্রবণতা আছে।
    গজ চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে যেতে লাগল। ঘরবাড়ি-বাগান-পুকুর সবই সাধারণ, সবই যেন দেখা দেখা!
    লোকটা এগিয়ে যাচ্ছিল, গজ ডাক্তার জোর পায়ে হেঁটে তাকে ধরে ফেলে বলল, এইসব জায়গা কী এরিয়া?
    লোকটা অবজ্ঞায় নাক কুঁচকে বলল, এইসব মিডল ক্লাসের!
    ওর অবজ্ঞার ভাবে রাগ এলেও গজ বুঝল, এর কাছ থেকেই সব তথ্য জানা যাবে। আস্তে বলল, তো ভাই শুনেছি—পরলোকে নাকি স্বৰ্গ আছে নরক আছে, সেসব কই?
    লোকটা আরো অবজ্ঞায় বলল, আছেই তো। কে বলল নেই? তো তোমার চোখের সামনে ঝুলে থাকবে নাকি?
    সে তো বটেই, সে তো বটেই। তো কোথায় কোন রাজ্যে আছে?
   লোকটা গোঁফে তা দিয়ে বলল, এই রাজ্যেই আছে। চিত্রগুপ্তর রাজ্যে। স্বর্গটা হচ্ছে গিয়ে ‘পশ এরিয়া’। মানে বড়মানুষদের পাড়া। সেখানে অভাব নেই, অসুবিধে নেই, জ্বালা নেই। শুধু ঐশ্বর্য জৌলুস, আরাম আয়েস, আর যা ইচ্ছে করার স্বাধীনতা।
    ওঁঃ । আর নরক?
   সে হচ্ছে গিয়ে বস্তি-ঝুপড়ি-নোংরা-কাদা-পচানালা-পেকো পুকুর, আর হতভাগা সব লোকেদের চেঁচামেচি। তো তোমার আবার স্বৰ্গ-নরকের খোঁজ কেন? তোমার পাসপোর্ট তো এই মিডলম্যান এলাকায়। আছে নাকি কেউ আপনজন স্বর্গে কিংবা নরকে? তো আমায় যদি টুপাইস দিয়ে দাও একবার দেখা করিয়ে আনতে পারি।
    গজ বলল, না আমার কেউ ওসব জায়গায় নেই। থাকলে এখানেই আছে। তো নাম বললে খুঁজে দিতে পারো?
    ও তুমি নিজেই খুঁজে পাবে। মেলা বোকো না। যত্ত সব ঝামেলা। চলো চলো।
    তো সেই গেল তো গেল। বটকেষ্ট রোজ ভাবে, কোথায় নিয়ে গেল গজকে! আর কি কখনো দেখা হবে? এই যে কত আপনজন এসেছে, এ যাবৎ কাউকে কি দেখতে পেয়েছে? ঠাকুর্দাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে। বড় ভালোবাসতো বুড়ো বটুকে। তো কে জানে সে এখন আবার সেতু পার হয়ে চলে গিয়ে কারুর ঘরে নতুন খোকা হয়ে জন্মে বসে আছে কিনা।
    তা শুধু কি ঠাকুর্দা? আরো কতজনই তো এসেছে বটুর জীবনকালে। কাকেই বা দেখতে পেয়েছে? একবার সেজ পিসেকে দেখেছিল, একবার নতুন জ্যাঠাকে, আর একবার পাড়ার শশীবাবুকে। তো শশীবাবু তো চোখাচোখি হতেই অচেনার ভান করে কেটে পড়লেন। পড়তেই পারেন। এখানে আসার আগে বটকেষ্টর কাছে বেশ কিছু টাকা ধার করেছিলেন কিনা, বিজনেস করব বলে।
    তো সে যাক। গজাটার কী হল? দিন মাস বছরের হিসেব নেই, হঠাৎ একদিন দেখতে পেল গজগোবিন্দ আসছে দু’হাত তুলে নদের নিমাইয়ের ভঙ্গিতে।
    বটা আছিস; ওঃ, কতদিন থেকে খুঁজছি। তোর এই ঘরও হারিয়ে মরেছিলাম। হঠাৎ আজ দূর থেকে দেখলাম তুই বসে আছিস। তো সে যাক—বটা স্কুল না গিয়ে তুই কবিতা লিখতিস না? আর কলেজ লাইফে নাটক?
    বটকেষ্ট অবাক হয়ে বলল, লিখতাম তো। তা এখন কী? 
    বলছি—আবার লেখ। আমি তোকে মেটিরিয়ালস দেব। 

   বটকেষ্ট হা হা করে হেসে উঠল, এখানে বসে কাব্য নাটক লেখা হবে?



এই যে কত আপনজন এসেছে, এ যাবৎ কাউকে কি দেখতে পেয়েছে? ঠাকুর্দাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে। বড় ভালোবাসতো বুড়ো বটুকে। তো কে জানে সে এখন আবার সেতু পার হয়ে চলে গিয়ে কারুর ঘরে নতুন খোকা হয়ে জন্মে বসে আছে কিনা।
    তা শুধু কি ঠাকুর্দা? আরো কতজনই তো এসেছে বটুর জীবনকালে। কাকেই বা দেখতে পেয়েছে? একবার সেজ পিসেকে দেখেছিল, একবার নতুন জ্যাঠাকে, আর একবার পাড়ার শশীবাবুকে। তো শশীবাবু তো চোখাচোখি হতেই অচেনার ভান করে কেটে পড়লেন। পড়তেই পারেন। এখানে আসার আগে বটকেষ্টর কাছে বেশ কিছু টাকা ধার করেছিলেন কিনা, বিজনেস করব বলে।
    তো সে যাক। গজাটার কী হল? দিন মাস বছরের হিসেব নেই, হঠাৎ একদিন দেখতে পেল গজগোবিন্দ আসছে দু’হাত তুলে নদের নিমাইয়ের ভঙ্গিতে।
    বটা আছিস; ওঃ, কতদিন থেকে খুঁজছি। তোর এই ঘরও হারিয়ে মরেছিলাম। হঠাৎ আজ দূর থেকে দেখলাম তুই বসে আছিস। তো সে যাক—বটা স্কুল না গিয়ে তুই কবিতা লিখতিস না? আর কলেজ লাইফে নাটক?
    বটকেষ্ট অবাক হয়ে বলল, লিখতাম তো। তা এখন কী? 
    বলছি—আবার লেখ। আমি তোকে মেটিরিয়ালস দেব। 
   বটকেষ্ট হা হা করে হেসে উঠল, এখানে বসে কাব্য নাটক লেখা হবে? 
   না হবার কী আছে? তুই যদি লেখা ছেড়ে রেলগুদামের মালবাবু বনে না যেতিস এখানে তো তোকে ওই লিখতেই হত রাতদিন। দেখলাম তো ঘাড় গুজে লিখেই চলেছে কত কতজন। বলল, এখন নাকি ভীষণ চাপ, যতসব শারদীয়া সংখ্যা বেরোনোর মুখ। তো তুই একবার পুরোনো অভ্যেসটা ঝালিয়ে নে। তখন তো তোর লেখাগুলো নিয়ে কাগজের সম্পাদকদের দোরে দোরে ঘুরতিস, আর মুখ শুকিয়ে ফিরে আসতিস। এখন দ্যাখ।
   বটকেষ্ট হতাশ গলায় বলল, এখনো তাই হবে। হবে না। গজগোবিন্দ শূন্যে একটা তুলোর ঘুষি মেরে বলল, শুনলাম, নরলোকে নাকি এখন পরলোক'এর খবরের জন্যে খুব চাহিদা। চটপট লিখে ফেলতে পারলে এই সামনের পুজোতেই কোনো একখানা গাবদা-গোবদা পত্রিকায় লাগিয়ে দিতে পারা যাবে। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে তুই এখানে এসে ওই মালই জন করেছিস, আর সেতুর লোক গুনেছিস। এখানের তথ্য-টত্য কিছুর ধার ধারিসনি। তো একখানা ঘুঘু রিপোর্টারের সঙ্গে বেশ পটিয়ে নিয়ে, আর নিজে ঘুরে ঘুরে অনেক সব মালমশলা জোগাড় করে ফেলেছি। বইয়ের নামও ঠিক করে ফেলেছি। তবে আমার তো লেখার অভ্যেস নেই! তুই কলমটা ধর।
    বটকেষ্টর প্রাণটা একটু হাহাকার করে উঠল। আহা! অভ্যেসটা যদি রাখত। তবে বলা যায় না। লোকে তো বলে, সাঁতার শিখলে আর সাইকেল চালাতে শিখলে লোকে নাকি জীবনে-মরণে ভোলে না। তা কলম চালানোটাও কি—
    কাঁপা গলায় বলল, বলছিস পারব?
    আলবৎ পারবি!
    কিন্তু ছাপবে কে? পড়বে কে?
    হ্যাঁ, সেটাই তো কথা।
   গজ বলল, তার জন্যে অবশ্য আমাদের নরলোকে নামতে হবে। কোনো একটা গাবদা ম্যাগাজিনের এডিটারকে কায়দা করতে হবে। তো তার জন্যে ভাবনা নেই। হয়ে যাবে। তেমন বেকায়দা করে একবার স্বরূপটা দেখিয়ে দেওয়া যাবে। ওঃ একবার লাগাতে পারলে—একদম হট কেক!
    বটকেষ্ট বলল, কী করে বুঝছিস?
আরে জানিস না জ্যান্ত মানুষদের চিরটাকালই এই মরে যাওয়াদের সম্বন্ধে অগাধ কৌতুহল। প্ল্যানচেটে আত্মা নামায়, খুঁজে খুঁজে পরলোক তত্ত্বর বই পড়ে। চিরটিকাল! তোর মনে আছে, আমাদের ইস্কুলের হেডসার ‘পরলোকের কথা’ বলে একটা সিরিজ লিখতেন? কী তার ডিম্যান্ড! অথচ সবই অন্যের বই থেকে টুকলিফাই! গাদাগাদা বই জোগাড় করতেন—ইংরিজি-বাংলা—
    খুব মনে আছে।
    তবেই বোঝ? টুকে মেরে বাহাদুরি। আর আমাদের এ বই একদম প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ!!
    কিন্তু গজু, লেখার সরঞ্জাম?
   গজু মুচকি হেসে বলে, সে কি আর জোগাড় না করে বলছি? এই দ্যাখ একটা উঠতি কবির টেবিল থেকে বাগিয়ে আনলাম। দিস্তে দিস্তে কাগজ মজুত রেখেছে, গোছা গোছা ডট্‌পেন! এন্তার লিখছে আর ছিড়ে দলা পাকিয়ে ফেলে দিচ্ছে। লিখছে আর ছিড়ছে। ছিড়ছে আর লিখছে। ভুক্ষেপও নেই যে টেবিল থেকে একদিস্তে কাগজ আর একগোছা ডটপেন উপে গেল। এই নে। নাটকাকারে লেখ, ঝপাঝপ এগিয়ে যাবে।
    বটকেষ্টকে ধরে দিল গজগোবিন্দ সেই বাগিয়ে আনা কাগজ-কলম।
    গজু রে—
    বটু বলে উঠল—ওরে আমার খাস্তাগজ, জিবেগজা, নোনতা গজা, মশলা গজা! তোকে আমি বলেছিলাম, বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে গেছে। আয় একটু কোলাকুলি করি, যাক গে কাজ নেই। তো কী যেন বলছিলি, নামটা ঠিক করে ফেলেছিস!
    ফেলেছি! নাম হবে পরলোকের হাড়ির খবর!! প্রত্যক্ষদর্শীর কলমে—’!
    পরলোকের একটা গুণ ইচ্ছে মাত্রই কাজ হয়ে যায়। চটপট, ঝটপট।
    কাজেই বই শেষ হতে দেরি হল না।
    বটু বলল, তবে আর দেরি করা ঠিক নয়, অ্যাঁ। শারদীয়া সংখ্যার মরসুম তো এসেই গেল।
   গজু বলল, তবে চল। কিন্তু নাটকের প্রথম দৃশ্যটা একটু দেখা হবে না? আমি গড়গড়িয়ে বলে গেলাম, তুই খসখসিয়ে লিখে গেলি। জিনিসটা কী দাঁড়াল—
    বটকেষ্ট সেই দিস্তেভর্তি কাগজ বাগিয়ে মুড়ে ফেলেছে। আর খুলল না। বলল, গোড়াটা? মুখস্থই বলছি। প্রথম দৃশ্য—পরলোকের মহাফেজখানা।
    ঘরে ঘরে মন্ত্রী-উপমন্ত্রী, আমলা-সামলা, এবং ঘরের বাইরে অপেক্ষারত যত হ্যাংলা ক্যাংলা ন্যাংলা! তাদের আবেদন, পরলোকের পিওন চাপরাশি পাহারাদার ইত্যাদিরা সাধারণদের প্রতি বড়ই দুর্ব্যবহার করে। দুরছাই করে। নিজেদেরকে লাট সাহেব ভাবে—
    গজু চঞ্চল হয়ে বলে, থাক রে বটা। শুনতে গেলে আঠা ধরে যাবে, নেশা লেগে যাবে। তাহলে আজ আর যাওয়া হবে না। উঠে পড়া যাক।
    উঠে পড়া মানেই হাওয়ায় ভেসে সেই নদীতীরে সেতুর মুখে। কিন্তু সেতুর মুখের সামনে এক বিপত্তি। দুটো মুস্কো কালো লোক বুলডগের মতো মুখে বলে উঠল, থামো থামো! যাচ্ছ কোথায় হে জোড় মানিক? বলি যাবার পাসপোর্ট আছে?
    বটকেষ্ট ভয়ে ভয়ে গজুর দিকে তাকাল, কিন্তু গজুর নির্ভীক ভঙ্গি। পাসপোর্ট আবার কী হে? আসার সময় তো এসব ঝামেলা হয়নি। সরো সরো। সরার বদলে লোক দুটো ক্যাক করে দুজনকে ধরে ফেলে বলল, আসা আর যাওয়া এক হল? আসার সময় ওখানকার অফিস থেকে রিলিজ অর্ডার হয়ে গিয়েছিল, আমাদের লোক সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল।
    জানি। ডাঙস মারতে মারতে। তা বলে ভেবো না এখানের আইনকানুন আমি জানি না। সব জেনে ফেলেছি। পাসপোর্ট লাগবে তখন আবার যখন দুধের খোকা হয়ে ট্যাঁ ট্যাঁ করতে যাব। সে অনেক কাগজপত্র।
    লোক দুটো বলল, সে হবে না। ছাড়া হবে না। 
   তার মানে টু পাইস চাই? কেমন? নড়তে-চড়তে টু পাইস। পাবে-টাবে না। এই যাচ্ছি তোমাদের এখানকার কীর্তিকাহিনি কাগজে ছাপিয়ে দিতে।
    লোক দুটো ফস করে ওদের হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, কাগজের লোক? ও বাবা! 
    না, লেখক। বই লিখে নিয়ে যাচ্ছি ছাপাতে। 
    উরিব্বাস! লোক দুটো হঠাৎ নরম হয়ে গিয়ে হাত কচলে বলে, তাহলে আমাদের ‘কথা’ একটু লিখে দেবেন স্যার।
    তোমাদের আবার ‘কথা’ কিসের হে? দিব্যি যখন-তখন লোককে ডাঙস মারতে মারতে সাঁকো পার করে করে নিয়ে আসছ আর ‘মাসল” বাগাচ্ছ! তোফাই তো আছ।
    লোক দুটো অসন্তুষ্ট গলায় বলল, ওই তো। ওই দুঃখেই তো মরে আছি। হুকুমের চাকর, হুকুম মতোই চলতে হয়। তো এই নিকৃষ্ট কাজটায় আর মন নাই। যদি কাগজে লেখালিখি করে পৃথিবীতে একটা চাকরি মেলে—
    আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখা যাবে। এখন পথ ছাড়ো তো। লোক দুটো তাড়াতাড়ি পথ ছেড়ে দেয়। ওরা দুই বন্ধু সাঁকো পার হয়ে চলে আসে। তারপর বলে ওঠে, এখন কোন দিকে? - বটকেষ্ট বলে, কোন দিকে আবার? সোজা ‘রণডঙ্কা’ অফিসে। ব্যাটা সম্পাদক জন্মজীবনে আমার একটা লেখা ছাপেনি। সব অমনোনীত বলে ফেরত দিয়েছে। আবার কতগুলো ফেরত দেয়ওনি। ওকে দিয়েই এখন এই বই ছাপিয়ে নিতে হবে।
    গজগোবিন্দ বলল, নিয়েছিস তো গুছিয়ে? 
    সে আর বলতে।

    বিকেল চারটে। ‘রণডঙ্কা’ সম্পাদক খগেন ঘোষাল যথারীতি চেয়ারটা টেনে টেবিলের ধারে বসে ডিশ ঢাকা চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে মুখে ঠেকিয়ে 'আঃ' বলে ওঠবার বদলে বিশাল হাক পাড়লেন, বনমালী! এই বনমালী! এ কী দিয়ে গেছিস আমায়? চা না নিমের পাচন? বনমালী!
    বনমালীর সাড়া পাওয়া গেল না। তার বদলে কোথা থেকে যেন একটা ‘খি-খি-খি-খি’ হাসির শব্দ শুনতে পাওয়া গেল।

    এর মানে? খগেন ঘোষালের চুল খাড়া হয়ে উঠল। এত সাহস হয়েছে ব্যাটার। আবার হাঁক পাড়লেন, এই ব্যাটা বনমালী। বদমাশ শয়তান। আবার হাসি! চায়ে দুধ আর চিনি দিয়ে যা।
    আবার হাসি। খি-খি-খি। 
   খগেন ঘোষাল এখন সচকিত হলেন। হঠাৎ এতটা দুঃসাহস হবে বনমালীর? শব্দটা যেন ঘরের মধ্যেই খেলে বেড়াচ্ছে। দেওয়াল থেকে সিলিঙে, সিলিং থেকে দেওয়ালে।...নাকি জানলার বাইরে থেকে?
    তবু আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন, বনমালী। 
    তখন সেই হাসিরাই জবাব দিল, বনমালীর আঁশ ছাডুন। সে এখন চোখ উল্টে হাত-পা খিচছে।
    খগেন ঘোষাল সাহসী ব্যক্তি। তিনি কড়া গলায় বললেন, তোমরা কে হে? কোথা থেকে কথা বলছ?
    আঁগ্যে এই আপনার সামনে থেকেই। আপনি যদি চোখ থাকতে অন্ধ হন আমরা নাচার। এই আপনার ডান দিকে আমি কবি বটকেষ্ট পাল। আর আপনার বাঁদিকে আমার বন্ধু ডাক্তার গজগোবিন্দ খাসনবীশ!
    খগেন ঘোষাল অনুভব করলেন তার দুটো হাতের ওপর দিয়ে একটা হিমালয়ের হিমেল হাওয়া বয়ে গেল।
   খগেন ঘোষাল কোনোমতে জামার মধ্যে থেকে পৈতেটা টেনে বার করে মনে মনে রামনাম জপ করতে করতে বললেন, কী উদ্দেশ্যে হঠাৎ আমার এখানে?
    দুটো গলা থেকে বা দুটো নাক থেকে একসঙ্গে একটা কথা উচ্চারিত হল, উদ্দেশ্য মহৎ। ‘রণডঙ্কা'র শারদীয়ার জন্যে একখানা বিশ্বের সেরা কৌতুক-নাট্য এনেছি, পরলোকের হাড়ির খবর। এটা এ বছর পুজো সংখ্যা ‘রণডঙ্কায়’ ছাপিয়ে দেবেন।
    ছাপিয়ে দেবেন।
   শুনেই খগেন ঘোষালের সম্পাদক সত্তাটি তেলে-বেগুনে জুলে ওঠে। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে চেঁচিয়ে ওঠেন, ছাপিয়ে দেব? মামাবাড়ির আবদার? পুজো সংখ্যার সব কমপ্লিট হয়ে গেছে, বুঝলেন? কেটে পড়ুন! কেটে পড়ুন।
    কী! কেটে পড়ব? অতো সস্তা না। তুমি বুড়ো খগেন ঘোষাল। একদা আমায় অনেক কাট মারিয়েছ। আর ছাড়ান না। দেখিস বুড়ো, এ লেখা বাজারে পড়তে পাবে না। হট কেকের মতন উঠে যাবে। শারদীয় ‘রণডঙ্কা’ আবার ছাপাতে হবে।
    আপনি’ থেকে ‘তুমি’, তুমি থেকে ‘তুই’।
    মানুষের সহ্যের একটা সীমা আছে তো?
   খগেন ঘোষাল চেঁচিয়ে ওঠেন, পুলিশ। পুলিশ। কনস্টেবল, কনস্টেবল। পাহারোলা। পাহারোলা। ও. সি. ও. সি! মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যপাল! রাজ্যপাল। জৈল সিং! জৈল সিং! রাজীব! রাজীব!


হে হে, খে খে হিক হিক, হঠাৎ যেন অদৃশ্য শূন্যে দুটাে গলা দুইয়ে শূন্য কুড়িটা হয়ে হাসির বান ডাকিয়ে দেয়, ও বটা! তোর এডিটার দাদু অ্যাতো নার্ভাস? শুদু বাঁশী শুনেই এই চোকে দেখলে তো—তা থাকগে! আপনাকে আর ভিমি খাওয়াবো না। এই লেখাটা দিয়ে যাচ্ছি, ছাপা হওয়া চাই। দে বটা, দিয়ে দে। থলিটা উপুড় করে দিয়ে চটপট চলে যাই।
    ব্যস থলি উপুড় করে বটকেষ্ট। আর সেই লেখারা খগেন ঘোষালের গা-মাথা টেবিল-চেয়ারের ওপর ঝরঝরিয়ে ঝরে উপচে ছড়িয়ে পড়ে।
    কী এ? কী এ? আ আ আ। এ সব কী? 
   চেয়ার ঠেলে টেবিল উল্টে চায়ের পেয়ালা ভেঙে কালির দোয়াত ছিটকিয়ে সারাঘরে দাপাদাপি করে বেড়ান খগেন ঘোষাল আর্তনাদ করতে করতে, বনমালী। বনমালী! তুই কি মরে গেছিস! ওরে বাবারে! এগুলো কিরে?
    ক্যানো? এই তো আমাদের কালজয়ী কৌতুক-নাটক পরলোকের হাড়ির খবর-এর ম্যানাসক্রিপট্ৰ পিন করা হয়নি, গুছিয়ে নেবেন। ছাপাবেন তো দাদা, অ্যা—! না ছাপালে কিন্তু--
    না ছাপলে কী হবে তা আর শুনতে পান না খগেন ঘোষাল। কারণ? কারণ তখন— চোখের সামনে ঝলসে উঠেছে একজোড়া ‘স্বরূপ’। দু'প্রস্থ মুলোর সারিতে ফিক ফিক হাসি, আর দুখানা দুখানা চারখানা কুলো’র লটপটানি।
    ভির্মি খেয়েই দুমাস করে পড়ে যান খগেন ঘোষাল। ফেনা ওঠা মুখে একটি আওয়াজ বেরোয়, ফুঃ ফুঃ ফুঃ লিঃ শ।
    ওরা সাঁকোয় উঠে হাস্যবদনে বলে, নাটকটা যদি স্টেজে নামায় খুব জম্পেস হবে, কী বলিস?

     এদিকে নরলোকের হাড়ির খবর এই— 
    পুলিশ কোনো কাজের নয়’ একথা ভুল। ঘণ্টাকয়েক পরেই এসেছিল পুলিশ। যা করবার করেও ছিল। চটপট। পরদিনই কাগজে কাগজে খবর, ‘রণডঙ্কা পত্রিকা’ অফিসে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড!!....গতকাল বিকালে দুইজন দুৰ্বত্ত ‘ভূতের ছদ্মবেশে পত্রিকা অফিসে বলপূর্বক হানা দিয়া তাণ্ডব-নৃত্য শুরু করে। যথেচ্ছ ভাঙচুর ও মারপিটের পর সম্পাদককে শাসাইয়া রাশি রাশি হিজিবিজি আঁকিজকি কাটা কাগজের টুকরা সর্বত্র নিক্ষিপ্ত করিয়া রহস্যজনকভাবে অন্তর্ধান করে।
    কাগজগুলি দেখিয়া মনে হয় কোনো সাঙ্কেতিক ভাষায় লিখিত বিশেষ ইস্তাহার! দুর্বোধ্য ভাষায় লিখিত এই ইস্তাহারের কয়েকটি নমুনা পাঠোদ্ধারের জন্য বিশেষজ্ঞ দিগের কাছে পাঠানো হইয়াছে।

    আততায়ীদিগের উদ্দেশ্য বোঝা যাইতেছে না। কেহ ধরা পড়ে নাই। সম্পাদক খগেন ঘোষাল ও বেয়ারা বনমালী দাস এখন হাসপাতালে।’


Thanks for visiting my Blog.

Labels:

Tuesday, 22 May 2018

প্রেতের কান্না

প্রেতের কান্না
 - শ্রীযোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়


সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে জমজমাট অন্ধকার। দেবকুমার বুঝতে পারল সে পথ হারিয়ে ফেলেছে—বন্ধু রজতের বাড়ি খুঁজে বার করা একেবারেই অসাধ্য। কত চেষ্টাই তো করল সে! কিন্তু রজতের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পথ সে খুঁজে বার করতে পারল না ।
মনে মনে জেগে ওঠে তার শত অনুতাপ। রজত তাকে বারণ করেছিল। সে বলেছিল বারবারই, “শোনো দেবকুমার, এসব পাহাড়ে জায়গা একেবারেই ভালো নয়, এখানে-সেখানে কত বিপদ ওৎ পেতে বসে আছে! কাজেই বিকেল পাঁচটা না বাজতেই ফিরে এসো !”
সে তখন হেসেছিল বিদ্রুপের হাসি! একটা শক্ত-সমর্থ জোয়ান ছেলে সে, পাহাড়ে পথ বলেই কি তার বিপদ হবে? সে কি পাঁচ বছরের কচি ছেলে যে তাকে সহজেই কেউ বিপদে ফেলতে পারে?
তখন এমনি কত কথাই তার মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন ? এখন যে বাচ্চা ছেলের মতোই সে পথ হারিয়ে ফেলল ? এখন কোথায় সে যাবে? কেই বা তাকে আশ্রয় দেবে?
হ্যাঁ, ঐ যে দূরে একটা আলো দেখা যায় না?
দেবকুমারের আশা হল, নিশ্চয়ই ঐখানে কোনো বসতি আছে, ওখানে গেলে সে নিশ্চয়ই একটু আশ্রয় পেতে পারে।
দেবকুমার জোরে পা চালিয়ে দিল। মিনিট দশেক পরেই দেখা গেল, এক প্রকাণ্ড বাড়ি তার সুমুখে দাঁড়িয়ে। বাড়িটি জীর্ণ পুরাতন হলেও বুঝতে কষ্ট হয় না যে এককালে এর পেছনে ছিল বিরাট ধনীর কোনো ইতিহাস!
বিরাট সিংহ-দরজা—লৌহ-ফটক। তারই মাথায় মিট্‌মিট্‌ করে একটা আলো জ্বলছে। অর্ধ-উন্মুক্ত ফটকের এক কোণে একখানি চেয়ারে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক উপবিষ্ট। পরম নিশ্চিন্ত মনে তিনি হুকো হাতে ধূমপানে ব্যস্ত।
দেবকুমারের পায়ের শব্দে চমকিত হয়ে তিনি তার আধখোলা চোখ দুটি ভালো করে খুললেন ও একটু সোজা হয়ে বসলেন।
“দেখুন, আমি বড় বিপন্ন। পথ হারিয়ে ফেলেছি। আজ রাতের মতো আপনার এখানে একটু আশ্রয় প্রার্থনা করি।”
দেবকুমারের কথায় অসহায় মিনতি ঝরে পড়ে।
ভদ্রলোক একবার দেবকুমারের আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিলেন। তারপর কোনো কথা না বলে পাশের একটি ছোট বোতামে চাপ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভিতরে কোথাও ঝন্‌ঝন্‌ করে ঘণ্টা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবয়সী এক পরিচারিকা সেখানে উপস্থিত হল।
ভদ্রলোক ঠিক তেমনিভাবে তামাক খেতে খেতেই নীরবে দেবকুমারকে দেখিয়ে তাকে ভিতরে নিয়ে যেতে ইঙ্গিত করলেন। দেবকুমার পরম কৃতজ্ঞভাবে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পরিচারিকার পেছনে পেছনে ওপরে যাওয়ার সিঁড়িপথে অন্তর্হিত হয়ে গেল।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ দেবকুমার বুঝতে পারে না তার ঘুম ভাঙল কেন! নিশুতি অন্ধকার রাত, কিন্তু কেমন একটা থমথমে ভাব!
সে তার বালিশের তলা হতে টর্চটি টেনে বার করতে যায়। কিন্তু মনে হল তার খাটসুন্ধু গোটা বিছানাই যেন মেজে হতে উঁচু হয়ে উঠেছে! কি এ?
দেবকুমার বসতে চেষ্টা করল বিছানার ওপর। কিন্তু বসতে গেলেই পড়ে যায়, আবার সে লুটিয়ে পড়ে বিছানার ওপরেই। কারণ, সমস্ত খাটখনি তখন প্রায় তিন হাত উঁচুতে শূন্যে উঠে গেছে!
দেবকুমার ভীত-সন্ত্রস্ত ভাবে শেষ পরিণতি লক্ষ করতে লাগল! সহসা ধপ করে খাটখানি পড়ে গেল। প্রচণ্ড শব্দে দোতলার মেজে থরথর করে কেঁপে উঠল। মনে হল, কোনো মত্ত হস্তী বুঝি তার মাথা দিয়ে খাটখানা ঠেলে ফেলে দিলে!
পরক্ষণেই একটা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া! মুহুর্তে শীতে কেঁপে ওঠে দেবকুমার! হঠাৎ কার একটা মৰ্মভেদী নিঃশ্বাস তার মুখে এসে লাগে! কিন্তু এত ঠান্ডা। নিঃশ্বাস কি কখনো কারো এত ঠান্ডা হয়? এ যেন বরফের ছুরি।
দেবকুমার না-জানি কোন এক অজানা ভয়ে কখন তার চোখ অনেকটা বন্ধ করেই ফেলেছিল! কিন্তু আসলে সে তো ভীরু নয়। সাহসী বলে তার রীতিমতো সুনামই ছিল। কাজেই তার সমস্ত জড়তা ও ভয় সে এইবার দূরে ঠেলে ফেলে দেয়, পূর্ণ বিস্ফারিত চোখে তাকায় সে। কিন্তু চাইতেই—ও কি? খোলা জানলায় একখানা বীভৎস মুখ, সে মুখে এক তিলও মাংস নেই, সাদা ধবধবে হাড়ের মুখ..নাক-চোখের জায়গায় তিন-তিনটে গর্ত, দুঠোঁটের জায়গায় দুসারি দাঁত বেরিয়ে আছে। এক মুহুর্তের জন্যে দেবকুমারের মাথাটা ঘুরে গেল, তার চোখ দুটি আপনা হতে বন্ধ হয়ে গেল।

হঠাৎ একটা বিশ্ৰী হাসির শব্দে চমকে ওঠে দেবকুমার...কিন্তু এ কি? কোথায় সে বীভৎস মুখ? এত বড় বিস্ময়কর ঘটনাকেও ছাপিয়ে আর একটা বিভীষিকা ফুটে উঠল তার চোখের সামনে।

সে দেখে, দুটি করুণ চোখ—সুন্দরীর চোখই তাকে বলা যায়—একান্ত মিনতি-মাখা,— দেবকুমারের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে তাকিয়ে আছে!
দেবকুমারের বুকের রক্ত মুহুর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়! কে যেন একরাশ বরফের ছোপ তার দেহমনে বুলিয়ে গেল!
চোখ তার বন্ধ করে দেবকুমার—ভয়ে বা বিস্ময়ে। পরক্ষণেই আবার সে চোখ মেলে তাকায়। কিন্তু তখনো সেই চোখ—ঠিক তেমনিভাবে—তারই মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। তার এক ঝলক ঠান্ডা নিঃশ্বাস দেবকুমারের কপালে এসে বুঝি কাঁপুনি জাগিয়ে তোলে।
সহসা—একটা প্রচণ্ড শব্দ! সজোরে দরজাটা কে খুলে ফেলল। পরক্ষণেই একটা প্রকাণ্ড জোয়ান লোক ঝড়ের বেগে ঘরে ঢোকে। ঢুকেই সে এক লাফে মহিলার দিকে এগিয়ে এল। তারপর মুহুর্তমধ্যে তার চুল ধরে টেনে তাকে মাটিতে ফেলে দিল!
আর্তনাদ করে উঠল সেই বিপন্ন মহিলা। কিন্তু পরক্ষণেই সেই জোয়ান লোকটার হাতে চক্‌চক্‌ করে ওঠে একখানি শাণিত ছুরি আর সহসা স্তব্ধ হয়ে গেল মহিলার কণ্ঠস্বর।
দেবকুমারের চোখের সম্মুখে রক্তের নদী বয়ে যায়! মহিলার রক্তাক্ত দেহ তার মাঝখানে। দেবকুমার সে দৃশ্য আর দেখতে পারে না—ভয়ে সে চোখ বন্ধ করল!
কতক্ষণ সে এইভাবে ছিল বলা যায় না—কিন্তু কি এক বিচিত্র শব্দে চমকিত হয়ে আবার সে
চোখ মেলে চায় !—
ওঃ! কি ভয়ঙ্কর! নিহত মহিলার চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। কি তার উত্তাপ আর কি তার জ্যোতি! সমস্ত ঘরে যেন আগুন জ্বলে উঠেছে! আর সেই আগুনের মাঝখানে রক্ত-সমুদ্রে সেই সুন্দরী মহিলা! তার সর্বদেহ রক্তমাখা, বুকের একপাশ দিয়ে তখনো বয়ে চলে ফুটন্ত রক্তস্রোত! দেবকুমার স্তব্ধ, হতবাক! কিন্তু কিসের আকর্ষণে সে চোখ তার ফেরাতে পারল না, মন্ত্ৰমুগ্ধ শিকারের মতো সে যেন শিকারির চোখে চোখ মিলিয়ে ঠিক তেমনি ভাবেই তাকিয়ে রইল!
মহিলা হিংস্র দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকায়, ঠোঁট তার কেঁপে ওঠে। না-জানি কোন অভিসম্পাত সে বিলিয়ে দেয় অত্যাচারী পৃথিবীর বুকে!
সহসা দূরে কেন অসংখ্য পদশব্দ?—দূর হতে কাছে, ক্রমশই আরো কাছে, কে জানে কত লোকজনের পদশব্দ নৈশ স্তব্ধতা ভারী করে তোলে!
দেবকুমার বুঝতে পারে, একজন দুজন নয়, অসংখ্য লোক—হিংস্র শিকারির মতো বাড়িতে ঢুকে পড়েছে! তাদের হৈ-হল্লা ও অস্ত্রের ঝঞ্জনায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, সমস্ত পৃথিবী যেন দারুণ ভয়ে তার চোখ বন্ধ করে ফেলল!
বুক কেঁপে ওঠে দেবকুমারের! কিন্তু সে বুঝি চিৎকার করবার শক্তিটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে! হঠাৎ কিসের বিজয়-উল্লাসে সমস্ত আকাশ-বাতাস ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল! সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে ঝড়ের মতো ঘরে ঢোকে একপাল যমদূত—সকলেই সশস্ত্র ভয়ঙ্কর! কিন্তু তাদের পুরোভাগে সেই মহিলার হত্যাকারী নৃশংস ব্যক্তি।
হিড়্‌ হিড়্‌ করে টেনে তাকে ঘরে নিয়ে এল যমদূতের দল। তারপর তার দেহের সর্বত্র এলোপাথাড়ি চলে অসংখ্য অস্ত্রাঘাত। ছোরা, তলোয়ার, শড়কি-বল্লম তাকে প্রায় ভূমিতলে গেঁথে ফেলে। মহিলার ফুটন্ত রক্তের সঙ্গে তার সদ্যোনিঃসৃত রক্ত মিশে একাকার হয়ে গেল!
“হাঃ! হাঃ! হাঃ! হাঃ!”—একটা বীভৎস অট্টহাসিতে মহিলা উল্লসিত হয়ে ওঠে। আর সঙ্গে সঙ্গে কোথা হতে বুঝি বা ছাদ ফুঁড়ে টুপটাপ ঝরে ঝরে পড়তে লাগল কতকগুলি কচিকাচা ছেলেমেয়েদের রক্তমাখা ছিন্নশির ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
আর্তনাদ ও উল্লাসের চিৎকারে কান ঝালাপালা হয়ে যায়, আর ঠিক সেই মুহুর্তে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে সেই বিশাল বাড়িখানির ভিত পর্যন্ত কেঁপে ওঠে।
প্ৰলয়-দোলায় কেঁপে ওঠে দেবকুমারের সমস্ত খাটখানি, টগবগে ফুটন্ত রক্ত তার কপালে ও মুখে ছিটকে এসে লাগে! কয়েকটা ভয়ঙ্কর হিংস্র যমদূত গোটাকয়েক বীভৎস কঙ্কাল সহ অবশেষে দেবকুমারের দিকেও তেড়ে এল!
ভয়ে শিউরে উঠল দেবকুমার! দু’হাত মাথায় তুলে সে প্রাণপণে চিৎকার করে ওঠে, “বাঁচাও ! বাচাও!”—

জ্ঞান যখন হল, তখন সে দেখে, তার বন্ধু রজত ও একজন ডাক্তার তার পাশে বসে! ভাবতে চেষ্টা করে সে, কোথায় সে আছে আর কেমন করে এল ? চোখ চাইতে পারে না সে। অবশেষে ধীরে ধীরে মনে আসে তার সব কিছু। কিন্তু বুঝতে পারে না, নিশীথের সেই ভয়ঙ্কর প্রাসাদে ওরা দুজনই বা এল কখন আর কেমন করে এল!
“কেমন করে এল?”—সম্ভবত তার বুকের ভাষা মুখে ফুটে বেরিয়েছিল একটু জোরেই।
রজত বলে, “হ্যাঁ ভাই, এ প্রশ্ন তোমার মনে জেগে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। সংক্ষেপে বলছি শোনো—
অনেক রাতে তুমি যখন ফিরলে না, তখন আমার এই ডাক্তার বন্ধুটিকে নিয়ে তোমায় খুঁজতে বেরেই। এ বাড়িটা আমার বাড়ি হতে প্রায় মাইল তিনেক দূর।
এর কাছাকাছি আসতেই তোমার একটা আর্তনাদ আমাদের কানে আসে। আমরা তখুনি টর্চ হাতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ি। এসে যা দেখলুম, তাতে আর আশা হয়নি যে তোমাকে জীবন্ত ফিরে পাব। দেখি, তুমি এই খাটের ওপর পড়ে আছ, কিন্তু মাথা তোমার মাটিতে ঝুলছে! আর তোমার নাকমুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে!—”
বাধা দিয়ে দেবকুমার বলে, “কিন্তু ওরা সব গেল কোথায়? সেই নিহত মহিলা, বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কাটা মাথাগুলি—সেই রক্তনদী—রক্তস্রোত—”

“থামুন,” বাধা দিয়ে বলেন ডাক্তারবাবু, “ওকথা আর ভাববেন না দেবকুমার! সম্ভবত প্রত্যহ গভীর রাতে মহিলার অতৃপ্ত আত্মা তার গোপন আবাস হতে বেরিয়ে আসে। আর তারপর যা হয়ে থাকে, সে সম্ভবত বাস্তবের পুনরাভিনয় । জীবনে একদিন যা হয়েছিল, এবাড়ির ভৌতিক অধিবাসীরা আজও তার রিহার্সেল দিয়ে যাচ্ছে!
যাহোক দিন তো প্রায় শেষ হয়ে এল। আর দু’এক ঘণ্টা এখানে থাকতে পারলে এবাড়ির আরো কিছু গোপন রহস্য হয়তো উদ্ধার করা যেত, কিন্তু সে কি সঙ্গত হবে ভাই?—”
“ও কি?” চিৎকার করে ওঠেন ডাক্তারবাবু। সেদিকে তাকিয়ে তারা দেখে, একপাল সাদা ও কালো বাদুড় হঠাৎ জানালার সার্সিতে এসে মাথা ঠুকে মরছে! তাদের কুৎকুতে রক্তচোখে হিংস্র ঝলক!
জোরে চিৎকার করে ওঠে রজত, “না আর নয়। এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ো দেবকুমার! বেরিয়ে পড়ো ডাক্তার। নইলে সমস্ত আত্মা আজ আবার প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে আসবে—”
মুহুর্তে ছুটে বেরিয়ে যায় সবাই। মনে হল কারা যেন তাদের পিছু পিছু বেগে ছুটে আসছে! নাগাল পেলেই বুঝি বা ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।


Thanks for visiting my Blog.

Labels:

হলদে মুখের কাহিনি [দি ইয়েলো ফেস]

হলদে মুখের কাহিনি [দি ইয়েলো ফেস]
            - শার্লক হোমস


শার্লক হোমসের সফল কীর্তির মধ্যে তার বুদ্ধিবৃত্তি যতটা প্রকাশ পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছে তার বিফল কীর্তির মধ্যে ! যে-কেস সে সমাধান করতে পারেনি, তা শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিতই থেকে গেছে— কারো বুদ্ধিতে কুলোয়নি মীমাংসা করার।
    হলদে মুখের কাহিনি সেই জাতীয় কাহিনি যার মধ্যে ওর আশ্চর্য বিশ্লেষণী ক্ষমতা সম্যকরূপে প্রকাশ পেয়েছে— অথচ হালে পানি পায়নি।
    অহেতুক শক্তিক্ষয় করা হোমসের ধাতে ছিল না। দেহে শক্তি ছিল যথেষ্ট। বক্সিংয়ে প্রথম শ্রেণির বক্সারদের মধ্যে ওর স্থান। কিন্তু কাজের সময় ছাড়া বাজে শক্তিক্ষয়ে ছিল ভীষণ অরুচি— কোকেন নিয়ে পড়ে থাকত মামলা হাতে না-থাকলে। কিন্তু কর্মক্ষমতা মরে যেত না— নিয়মিত ব্যায়াম ছাড়াই কীভাবে যে নিজেকে কর্মপটু রাখত ভেবে পাইনি। খেত খুব সামান্য। কিন্তু হাতে কাজ এলে শক্তি যেন বিস্ফোরিত হত হাতে পায়ে। প্রচণ্ড পরিশ্রমেও ক্লান্ত হত না। বসন্তকাল। জোর করে ওকে নিয়ে বেড়াতে গেলাম বাগানে। বাসায় ফিরলাম পাঁচটায়। আসতেই চাকরের মুখে শুনলাম, বসে থেকে থেকে একজন দর্শনার্থী চলে গেছে।
    খুবই বিরক্ত হল হোমস। এমনিতে হাতে কাজ নেই। যাও-বা একজন মক্কেল এল, দেখাও হল না। বিকেলে বেড়াতে না-গেলেই হত। গজগজ করতে লাগল সমানে। এমন সময়ে টেবিলে দেখা গেল একটা পাইপ পড়ে রয়েছে।
    লাফিয়ে উঠল হোমস, ‘আরে! আরে! ওয়াটসন, এ তো তোমার পাইপ নয়। ভদ্রলোক ফেলে গেছেন নিশ্চয়। চমৎকার সেকেলে ব্রায়ার পাইপ— তামাকওয়ালা এ ধরনের তৈল-স্ফটিকের নলকে বলে অম্বর। লন্ডনে এমন নল খুব একটা পাওয়া যায় না। এ-রকম একটা জিনিস ভদ্রলোকের অত্যন্ত আদরের— কাছছাড়া করতে চান না। তবুও যখন ফেলে গেছেন, বুঝতে হবে তার মানসিক উদবেগ নিশ্চয় চরমে পৌছেছে— পাইপ নিতেও ভুলে গেছেন।
    আদরের জিনিস— কাছছাড়া করতে চান না, তুমি বুঝলে কী করে?


    ভায়া, পাইপটার দামই তো সাত শিলিং। দু-বার মেরামত করা হয়েছে রুপোর পটি মেরে, মানে, পাইপের যা দাম, তার চাইতেও বেশি খরচ করে। নতুন একটা কিনলেও পারতেন। কেনেননি, অত্যন্ত আদরের এই পাইপ কাছছাড়া করতে চান না বলে।
    আর কী চোখে পড়ছে?


    হাড় ঠুকে প্রফেসর যেভাবে বক্তৃতা দেয়, তর্জনী দিয়ে পাইপ ঠুকে হোমস সেইভাবে বললে, পাইপ জিনিসটা চিরকালই কৌতুহলোদ্দীপক। ঘড়ি আর জুতোর মতো বৈশিষ্ট্যেরও দাবি রাখে। পাইপটার মালিক ল্যাটা, স্বাস্থ্যবান, ছন্নছাড়া। ভদ্রলোকের দাঁত বেশ সাজানো এবং পয়সাকড়ির ব্যাপারে হিসেব করে খরচ না-করলেও চলে যায়।
    তার মানে বড়োলোক?


    পাইপ থেকে তামাকটা হাতের চেটোয় ঢেলে হোমস বললে, ‘তামাকটা দেখছ? এ হল গ্রসভেনর মিক্সচার। বিলক্ষণ দামি। ব্যয়সংকোচে যে আগ্রহী, সে অনায়াসেই এর আধাদামের তামাক কিনে নেশা চরিতার্থ করতে পারত।
    আর কী দেখছ?


    ভদ্রলোক ল্যাম্প আর গ্যাসের শিখায় পাইপ জ্বালান বলে কাঠ পুড়েছে। দেশলাইয়ের আগুনে এভাবে কাঠ পোড়ে না। পুড়েছে কেবল ডান দিকটা, ল্যাটা বলে। তুমি ল্যাটা নও। তুমি ডান হাতে পাইপ ধরে ল্যাম্প বা গ্যাসের শিখায় পাইপ ধরালে দেখবে পুড়ছে বাঁ-দিকটা। অম্বর নলে দাঁতের দাগ যেভাবে বসেছে, তাতে মনে হয় ভদ্রলোকের দত্তশোভা দেখবার মতোই। দাঁত সাজানো জোরালো না-হলে এভাবে পাইপ কামড়ানো যায় না। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি। ভদ্রলোক স্বয়ং আসছেন মনে হচ্ছে।
    বলতে-না-বলতেই ঘরে ঢুকলেন বছর তিরিশ বছরের এক যুবক, হাতে টুপি, পরনে ধূসর পোশাক।
    আমতা আমতা করে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আমার মাথার ঠিক নেই। দরজায় নক করে ঢোকা উচিত ছিল।’ বলেই ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে উদ্রান্তের মতো হাত বুলোতে লাগলেন কপালে।
    আপন করে নেওয়া সুরে হোমস বললে, ‘দৈহিক মেহনত সওয়া যায়, রাত্ৰিজাগরণ সহ্য হয় না। আপনার দেখছি কয়েক রাত ঘুমই হয়নি।

    ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যেতে বসেছে আমার।’ আতীক্ষ ভাঙা ভাঙা গলায় যেন স্রেফ মনের জোরে আবেগরুদ্ধ ভঙ্গিমায় কথা বলে গেলেন যুবক। ‘ঘরের ব্যাপার নিয়ে পরের কাছে আলোচনা করার মতো কুৎসিত ব্যাপার আর নেই, বিশেষ করে ব্যাপারটা যদি নিজের ঘরণীকে নিয়ে হয়।’

‘মি গ্রান্ট মুনরো…’

    তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন যুবক,‘আমার নামও জানেন দেখছি।’
    হাসল হোমস। বলল, ‘নামটা আপনার টুপির ভেতর লিখে রেখে আমার দিকেই ফিরিয়ে রেখেছেন। আপনি স্বচ্ছন্দে আপনার কাহিনি বলুন। এ-ঘরে এর আগে অনেক গোপন রহস্য আমরা এই দুই বন্ধু শুনেছি, সমাধানও করেছি, অনেকের হৃদয়ের জ্বালা জুড়োতে পেরেছি। বলুন।
    আবার ললাটে হস্তচালনা করলেন গ্রান্ট মুনরো। হাবভাব দেখে বেশ বোঝা গেল কথা তিনি কম বলেন, মনের কথা মনে চেপে রাখতে পারেন, নিজেকে নিয়েই তন্ময় থাকেন, কিন্তু সেই অভ্যেসের অন্যথা হতে যাচ্ছে বলে নিজেকে আর সামলাতে পারছেন না।
    মি. হোমস, আমার বিয়ে হয়েছে তিন বছর আগে। তিন-তিনটে বছর আমরা পরম সুখে কাটিয়েছি। কেউ কাউকে ভুল বুঝিনি, কখনো মতান্তর হয়নি। কিন্তু গত সোমবার থেকে মনে হচ্ছে স্ত্রী অনেক দূরে সরে গেছে। কারণটা আমি জানতে চাই।
    ‘এফি কিন্তু আমাকে ভালোবাসে, তাতে একটুও চিড় ধরেনি। সেটা বোঝা যায়। কিন্তু একটা গুপ্ত রহস্য অদৃশ্য প্রাচীরের মতো দুজনের মাঝে হঠাৎ মাথা তুলেছে।
    এফিকে বিয়ে করেছিলাম বিধবা অবস্থায়। নাম ছিল মিসেস হেব্রন। আলাপ যখন হয়, তখন তার বয়স পঁচিশ। অল্প বয়সে আমেরিকায় গিয়েছিল। আটলান্টায় থাকত। বিয়ে হয়েছিল উকিল হেব্রনের সঙ্গে। একটি বাচ্চাও হয়েছিল। তারপরে পীতজ্বরে স্বামী আর সস্তানের মৃত্যু হওয়ায় ও দেশে ফিরে আসে। মি. হেব্রন ওর জন্যে যে-টাকা রেখে গেছিলেন তার সুদ পাওয়া যেত ভালোই। দেশে ফেরার ছ-মাস পরে আলাপ হয় আমাদের— তারপর বিয়ে।
    ‘হেব্রন ভদ্রলোকের ডেথ সার্টিফিকেট আমি দেখেছি।


    ‘আমার নিজের কারবার আছে। বিয়ের পর নবুরিতে একটা বাড়ি ভাড়া করলাম। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। পল্লিশ্রী আছে। আমাদের বাড়ির সামনে একটা ফাঁকা মাঠ। মাঠের ওপারে একটা কটেজ। আর কোনো বাড়ি নেই। কটেজটার সদর দরজা আমাদের বাড়ির দিকে।
    ‘আগেই একটা কথা বলে রাখি। বিয়ের পরেই স্ত্রী ওর সব টাকা আমাকে লিখে-পড়ে দিয়েছিল। আমার বারণ শোনেনি। ব্যাবসা করি, যদি টাকাটা জলে যায়, এই ভয় ছিল।
    ‘যাই হোক, দেড় মাস আগে এফি হঠাৎ আমার কাছে এক-শো পাউন্ড চাইল। আমি তো অবাক। এত টাকা হঠাৎ কী দরকার পড়তে পারে, ভেবে পেলাম না। জিজ্ঞেস করলাম। ও এড়িয়ে গেল। চপলভাবে শুধু বলল, “তুমি তো আমার ব্যাঙ্কার। ব্যাঙ্কার আবার অত কথা জিজ্ঞেস করে নাকি? তবে কী জন্যে টাকাটা নিচ্ছি, পরে বলব— এখন নয়।”
    ‘চেক লিখে দিলাম এক-শো পাউন্ডের। কিন্তু সেই প্রথম স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খোলাখুলি সম্পর্কে একটু ফাটল ধরল— কী যেন লুকিয়ে রাখা হল আমার কাছে।
    ‘বাড়ির উলটোদিকে মাঠের ওপারে দোতলা কটেজটার পাশে আমি প্রায় বেড়াতে যেতাম স্করফার গাছের কুঞ্জে। গত সোমবার বেড়িয়ে ফেরবার সময়ে দেখলাম, বাড়িতে নিশ্চয় ভাড়াটে এসেছে। এতদিন খালি পড়ে ছিল। এখন একটা খালি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মালপত্র সদর দরজার সামনে নামানো হচ্ছে।
    ‘কৌতুহল হল। কটেজের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি কে এল বাড়িতে, এমন সময়ে চমকে উঠলাম দোতলার জানলায় একটা মুখ দেখে। মি. হোমস, সে-মুখ দেখে বুকের রক্ত আমার ছলাৎ করে উঠল। কাটা দিয়ে উঠল গায়ে।
    মুখটা পুরুষের, কি নারীর দূর থেকে ঠাহর করতে পারলাম না। শুধু দেখলাম একটা বিষম বিকট হলদেটে রঙের মৃতবৎ মুখ স্থির চোখে দেখছে আমাকে। চোখাচোখি হতেই সাৎ করে পেছনে সরে গেল মুখটা— যেন জোর করে টেনে নেওয়া হল ঘরের ভেতর থেকে।
    ‘কৌতুহল আর বাগ মানল না। দেখতেই হবে কে এল আমার প্রতিবেশী হয়ে। এগিয়ে গেলাম সদর দরজার সামনে। কিন্তু ঢোকবার আগেই তালট্যাঙা একটা মেয়েছেলে বেরিয়ে এসে কড়া কড়া কথা বলে তাড়িয়ে দিলে আমাকে।
    ‘বাড়ি ফিরে এলাম। মন থেকে কিন্তু হলদেটে মুখটার স্মৃতি মুছতে পারলাম না। স্ত্রীকেও কিছু বলব না ঠিক করলাম। যা ভীতু স্বভাবের, ভেবে ভেবে হয়তো আধখানা হয়ে যাবে। শোবার আগে কেবল বললাম, সামনের বাড়িতে নতুন প্রতিবেশী এসেছে।
    ‘আমি কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোই। এই নিয়ে আমাকে রাগানোও হয়। কিন্তু সেদিন ওই বীভৎস হলদে মুখটা দেখার পর ঘুম তেমন গাঢ় হল না। চমকে চমকে উঠতে লাগলাম। সেই কারণেই গভীর রাতে টের পেলাম চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে উঠে পোশাক পরে এফি বেরিয়ে গেল ঠিক চোরের মতো ভয়ে ভয়ে। ঘড়ি দেখলাম। রাত তিনটে। এত রাতে বাড়ির বউ বাইরে বেরোয় কেন? বাইরে বেরোনোর সময়ে ওর মুখের চেহারাও দেখেছি। মড়ার মতো ফ্যাকাশে। নিশ্বাস নিচ্ছে ঘন ঘন। ব্যাপার কী?
    ‘কুড়ি মিনিট পর ফের সদর দরজা খোলা আর বন্ধ করার আওয়াজ পেলাম। চুপি চুপি ঘরে ঢুকল এফি। তৎক্ষণাৎ উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় গেছিলে?”
    ‘আঁতকে উঠল এফি। মুখ থেকে সমস্ত রক্ত নেমে গেল। কাঁপতে লাগল ঠক-ঠক করে। চিরকালই একটু নার্ভাস। তারপরেই ডুকরে কেঁদে বললে, “তুমি জেগে আছ?”
    ‘কোথায় গেছিলে?’



    ‘একটু হাওয়া খেতে। দম আটকে আসছিল বন্ধ ঘরে, দেখলাম আঙুল কাঁপছে এফির। নির্ঘাত মিথ্যে বলছে। 

আমার দিকেও তাকাচ্ছে না।
    ‘মনটা বিষিয়ে গেল। নিশীথ রাত্রে চোরের মতো বাইরে ঘুরে এসে যে-স্ত্রী কাঁচা মিথ্যে বলে স্বামীকে, তাকে আর জেরা না-করাই ভালো। পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুমোতে পারলাম না।
    ‘পরের দিন শহরে যাওয়ার কথা ছিল। বেরোলামও বাড়ি থেকে। কিন্তু মনমেজাজ ভালো না-থাকায় এদিক-ওদিক ঘুরে দুপুর একটা নাগাদ ফিরে এলাম। কটেজটার পাশ দিয়ে যখন আসছি, দেখলাম ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে আমার স্ত্রী।
    ‘আমাকে দেখেই যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল এফি। ভাব দেখে মনে হল এখুনি পেছন ফিরে কটেজের মধ্যে ফের ঢুকে পড়বে। নিঃসীম আতঙ্ক ফুটে উঠল চোখে-মুখে।
    কাঁদো-কাঁদো মুখে বললে, “জ্যাক’, নতুন প্রতিবেশী দেখতে এসেছিলাম।”

    “কাল রাতেও এসেছিলে?”
    “না, না। কী বলতে চাও?”
    “ফের মিথ্যে? দেখি তো কার কাছে গেছিলে।”

    ‘দু-হাতে আমার পথ আটকাল এফি। মিনতি করে বললে, ভেতরে যেন না-ঢুকি। এখন সে কিছু বলতে পারছে না শুধু আমার ভালোর জন্যেই। কিন্তু একদিন সব বলবে। কিন্তু এখন জোর করে ভেতরে ঢুকলে আমাদের সম্পর্কের ইতি ঘটবে ওইখানেই।
    “ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। কথা আদায় করলাম— আর যেন এসব না হয়। ও কথা দিল।
    ‘চলে আসার সময়ে লক্ষ করলাম, ওপরের ঘরের জানলা থেকে বিকট সেই হলদে মুখটা নির্নিমেষে চেয়ে আছে আমার দিকে। চোখাচোখ হতেই সাৎ করে সরে গেল ভেতরে। কিছুতেই মাথায় এল না এ-রকম একটা বিচিত্র জীবের সঙ্গে আমার স্ত্রী-র এমন কী সম্পর্ক থাকতে পারে যে রাতবিরেতে অথবা দিনদুপুরে আমাকে লুকিয়ে তাকে আসতে হচ্ছে বার বার? ওই কর্কশ স্বভাবের মেয়েছেলেটাই-বা কে? এ কী রহস্য গড়ে উঠেছে সামনের বাড়িতে?
    দু-দিন ভালোই কাটল। তৃতীয় দিন শহরে কাজ পড়ল। যে-ট্রেনে ফেরবার কথা ফিরলাম তার আগের ট্রেনে। বাড়ি ঢুকতেই আমার ঝি চমকে উঠল আমাকে দেখে। গিন্নিমা কোথায় গেছে জিজ্ঞেস করতে আমতা আমতা করে বললে, এই গেছে একটু বাইরে।
    ‘ঘোর সন্দেহ হল। ওপরে উঠলাম। এফিকে দেখতে পেলাম না। জানলা দিয়ে দেখলাম, মাঠের ওপর উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োচ্ছে ঝি। বুঝলাম সব। আমার অবর্তমানে ফের সামনের বাড়ি গিয়েছে এফি। ঝি যাচ্ছে আমার ফিরে আসার খবর দিতে।
    ‘মাথায় রক্ত চড়ে গেল। ঠিক করলাম, এর একটা হেস্তনেস্ত আজকেই করব। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঝড়ের মতো দৌড়োলাম কুটিরের দিকে। মাঝপথে দেখা হল এফি আর ঝিয়ের সঙ্গে— হন্তদন্ত হয়ে ফিরছে।
‘আমি কিন্তু ওদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঢুকলাম কুটিরের মধ্যে। নীচের তলায় দেখলাম জল ফুটছে কেটলিতে। ওপরতলায় হলদে মুখ যে-ঘরে দেখেছিলাম, সেই ঘরটা কেবল সুন্দর ভাবে সাজানো— ম্যান্টলপিসে রাখা আমার স্ত্রী-র ফটো— তিন মাস আগে তুলেছিলাম। এ ছাড়া বাড়ি একদম ফাঁকা।
    ‘নীচের হল ঘরে দেখা হয়ে গেল স্ত্রী-র সঙ্গে। ফটো কাকে দিয়েছে এবং কার কাছে সে এত লুকিয়ে চুরিয়ে আসে— এ-প্রশ্নের জবাব সে দিল না। করুণ স্বরে শুধু বললে, “বলতে পারব না জ্যাক। কিন্তু যেদিন সব জানবে ক্ষমাও করতে পারবে।”

    ‘আমি বললাম, “তোমার আমার মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক কিন্তু আর রইল না।”
মি. হোমস, সেই থেকে আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছি। এ-ঘটনা ঘটেছে কালকে। আপনার কাছে ছুটে এসেছি পরামর্শ নিতে। এ-উৎকণ্ঠা আর সইতে পারছি না। বলুন এখন কী করি।’
    তন্ময় হয়ে সব শুনল হোমস। গালে হাত দিয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ।
    তারপরে বললে, ‘হলদে মুখটা পুরুষের কি?’
    বলা মুশকিল!
    ‘দেখে গা ঘিন ঘিন করেছে?”
    বিকট রং, আড়ষ্ট ভাব দেখে সমস্ত শরীর শিউরে উঠেছে। দু-বারই চোখাচোখি হতেই লাফিয়ে পেছিয়ে গেছে।’
    ‘আপনার কাছে স্ত্রী টাকা নেওয়ার কদিন পরের ঘটনা এটা?”
    ‘মাস দুই।’
    ‘ওঁর প্রথম স্বামীর ফটো দেখেছেন?’
    ‘না। আটলান্টায় থাকার সময়ে আগুন লেগে সব পুড়ে যায়।’
    “কিন্তু ডেথ-সার্টিফিকেটটা দেখতে পেয়েছেন?”
    ‘সেটাও পুড়ে গিয়েছিল। আমি দেখেছি একটা কপি।
    ‘আমেরিকায় আপনার স্ত্রীকে চিনত, এমন কাউকে জানেন?’
    ‘না।’
    ‘ওঁর নামে চিঠি আসে আমেরিকা থেকে?
    ‘মনে তো হয় না।’
    ‘তাহলে এক কাজ করুন। বাড়ি ফিরে যান। কুটির থেকে যদি ওরা চম্পট দিয়ে থাকে এর মধ্যে, তাহলে কিছু করার নেই। আর যদি এর মধ্যে আবার ফিরে আসে— আপনি আড়াল থেকে তা দেখতে পেলেই আমাকে টেলিগ্রাম করে দেবেন— নিজে ঢুকতে যাবেন না। এক ঘন্টার মধ্যে পৌছে যাব আপনার কাছে।’
    বিদেয় হলেন গ্রান্ট মুনরো।
    ওয়াটসন,বলল হোমস, ব্যাপারটা খুব সুবিধের মনে হচ্ছেনা। ব্ল্যাকমেলিং চলছে মনে হচ্ছে।
    ‘ব্ল্যাকমেলারটি কে?’
    সাজানো ঘরে যে থাকে, মিসেস মুনরোর ছবি যে ম্যান্টলপিসে সাজিয়ে রাখে”, যার মুখ হলদে।”
    ‘সে কে?’
    মিসেস মুনরোর প্রথম স্বামী বলেই আমার বিশ্বাস। সেইজনেই দ্বিতীয় স্বামীকে ঢুকতে দিতে চান না। আমেরিকায় যাকে বিয়ে করেছিলেন, নিশ্চয় সে মারা যায়নি। অত্যন্ত কুৎসিত কুষ্ঠ জাতীয় কোনো রোগে এমন কদাকার হয়ে যায় যে ইংলন্ডে পালিয়ে আসেন ভদ্রমহিলা। কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ের খবর নিশ্চয় এমন কেউ পেয়েছে, যে প্রথম বিয়ের খবর ফাঁস করে দেওয়ায় হুমকি দেখিয়ে টাকা দোহন করছে ভদ্রমহিলার কাছ থেকে। নীচু ক্লাসের ছেলে-মেয়ের কীর্তি নিশ্চয়। প্রথম কিস্তির টাকা সে নিয়েছে, কদাকার অকৰ্মণ্য হেব্রনকে কটেজে এনে তুলেছে, ভয় দেখিয়ে মিসেস মুনরোর ছবি পর্যন্ত আদায় করেছে। গভীর রাতে মিসেস মুনরো গিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, দু-দিন পরে ফের গিয়েছিলেন ওই উদ্দেশ্য নিয়েই– কিন্তু মি. মুনরো হঠাৎ ফিরে আসায় ঝিয়ের মুখে খবর পেয়ে প্রথম স্বামীকে সেই বদ চরিত্রের মেয়েছেলেটির সঙ্গে পাচার করে দেন পেছনের দরজা দিয়ে।’
    ‘সবই তো আন্দাজে বলে গেলে।’
    এ ছাড়া আপাতত আর কিছু দরকার নেই।
    বিকেলে টেলিগ্রাম এল গ্রান্ট মুনরোর কাছ থেকে। বাড়িতে লোক দেখা গেছে। সাতটার গাড়িতে যেন হোমস রওনা হয়।
    যথাসময়ে পৌঁছোলাম নবুরিতে। স্টেশনে দেখা হল গ্রান্ট মুনরোর সঙ্গে। উত্তেজনায় কাঁপছেন ভদ্রলোক। ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন।
    পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে হোমস বললে, “আপনার পাছে অমঙ্গল হয় তাই আপনার স্ত্রী আপনাকে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দিতে নারাজ। তা সত্ত্বেও কি ঢুকবেন?
    ‘হ্যাঁ। এসপার কি ওসপার হয়ে যাক আজকে।’
    ইলশেগুড়ি বৃষ্টির মধ্যে পৌঁছোলাম কটেজটার সামনে। দোতলার একটা জানলায় আলো জুলছে। একটা ছায়ামূর্তি সরে গেল জানলার সামনে দিয়ে।
    ‘ওই... ওই. ওই সেই হলদে মুখ! যেন কঁকিয়ে উঠলেন গ্রান্ট মুনরো। আমরা সবেগে ধেয়ে গেলাম সদর দরজার সামনে। আচমকা খুলে গেল পাল্লা। পথ আটকে দাঁড়ালেন এক ভদ্রমহিলা।
    'না, এফি, বড্ড বেশি বিশ্বাস করে ফেলেছি তোমাকে। পাশ দিয়ে তেড়ে গেলাম তিন মূর্তি ভেতরে। একজন প্রৌঢ়া বেরিয়ে এসে পথ আটকাতে গিয়েও পারল না। ঝড়ের মতো উঠে গেলাম দোতলায়, সেই ঘরটিতে ঢুকে থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।
    ঘরটা সত্যিই সুন্দরভাবে সাজানো। টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে। ঝুঁকে রয়েছে একটা ছোট্ট মেয়ে। পরনে লাল ফ্রক। হাতে লম্বা সাদা দস্তানা। মুখটা আমাদের দিকে ফেরাতেই ভয়ে বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলাম আমি। সে-মুখে প্রাণের ফোনো সাড়া নেই, স্পন্দন নেই, রং নেই, অদ্ভুত হলদে। আড়ষ্টতা মুখের পরতে পরতে। ভাবলেশহীন বিষম বিকট।
    পরমুহুর্তেই অবসান ঘটল রহস্যের। একলাফে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার মুখ থেকে একটানে একটা মুখোশ খুলে আনল হোমস, মিশমিশে কালো একটা নিগ্রো মেয়ে ঝকঝকে সাদা দাঁত বার করে পরম কৌতুকে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল আমাদের ভ্যাবাচাকা মুখচ্ছবি দেখে।
    হেসে উঠলাম আমিও মেয়েটির কৌতুক-উজ্জ্বল সরল হাসি দেখে। আর গ্রান্ট মুনরো? চেয়ে রইলেন ফ্যালফ্যাল করে।

    “এ আবার কী!”

‘বলছি আমি, ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলেন নীচতলার সেই মহিলা। আমার প্রথম স্বামী আটলান্টায় মারা গেছে ঠিকই– কিন্তু মেয়েটি এখনও বেঁচে আছে!’
    তোমার মেয়ে!’ গলায় ঝোলানো রুপোর লকেটটা হাতে নিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এর মধ্যে কী আছে এই তিন বছরে তুমি দেখনি।
    ‘আমি তো জানি ওটা খোলা যায় না।’ খুট করে একটা আওয়াজ হল। স্প্রিংয়ে চাপ পড়তেই ডালা খুলে গেল লকেটের। ভেতরে দেখা গেল বুদ্ধি-উজ্জ্বল সুদৰ্শন এক পুরুষের প্রতিমূর্তি— আফ্রিকার কৃষ্ণকায় পুরুষ।
    ‘জ্যাক, এই আমার প্রথম স্বামী— জন হেব্রন। এর চাইতে উদার মহৎ মানুষ পৃথিবীতে আর নেই। বে-জাতে বিয়ে করেও তাই কখনো পস্তাতে হয়নি। মেয়েটা কিন্তু দেখতে হল ওর মতো। বরং ওর চাইতেও কালো তাহলেও সে আমার সোনা মেয়ে।’
    এই পর্যন্ত শুনেই মেয়েটা দৌড়ে ঝাপিয়ে পড়ল মায়ের বুকে।


    ‘মেয়েটাকে আমেরিকায় রেখে এসেছিলাম শরীর খারাপ ছিল বলে— হঠাৎ জায়গা পালটানোর ধকল সইতে পারত না। একজন আয়া ঠিক করে এসেছিলাম— সে-ই ওকে দেখাশুনা করত। সংকোচবশত তোমাকে ওর কথা বলতে পারিনি, সেটাই ভুল করেছি। চিঠিপত্র নিয়মিত পেয়েছি। জানতাম ও ভালোই আছে। বিয়ের তিন বছর পরে কিন্তু বড্ড মন কেমন করতে লাগল মেয়েটার জন্যে। এক-শো পাউন্ড পাঠালাম ওকে নিয়ে এখানে আসবার জন্যে। তখনও যদি তোমার কাছে লুকোছাপা না-করতাম, এত কাণ্ড আর ঘটত না। ভেবেছিলাম, কয়েক সপ্তাহ কাছে এনে রাখব। কটেজ ভাড়া করা হল। আয়াকে বলে দিয়েছিলাম দিনের আলোয় যেন কখনো মেয়েকে রাস্তায় বার না-করে। মুখ আর হাত মুখোশ আর দস্তানা দিয়ে ঢেকে রাখে, যাতে জানলায় যদি কেউ দেখেও ফেলে, পাড়ায় কালো মেয়ে এসেছে বলে প্রতিবেশীরা কানাকানি না আরম্ভ করে। এতটা আটঘাট না-বাঁধলেই দেখছি মঙ্গল হত। আমার মাথার ঠিক ছিল না পাছে তুমি সব জেনে ফেলো, এই ভয়ে।
    ‘তোমার মুখেই শুনলাম, ওরা এসে গেছে। মায়ের মন তো, তাই তর সইল না। তোমার ঘুম খুব গাঢ় বলে ঠিক করলাম রাতেই মেয়েটাকে গিয়ে কোলে নিই। কিন্তু তুমি দেখে ফেললে। তিনদিন পর যখন জোর করে কটেজে ঢুকেছিলে, ঠিক তার আগেই ওরা পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বাইরে। জ্যাক, এই হল আমার গোপন কাহিনি। এখন বল কী করবে হতভাগিনী মা আর মেয়েকে নিয়ে।’
    মিনিট দুই ঘর স্তব্ধ। তারপর গ্রান্ট মুনরো যা করে বসলেন, তাতে প্রাণ জুড়িয়ে গেল উপস্থিত প্রত্যেকের।
    মেয়েটাকে সস্নেহে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খেলেন। আর এক হাত বাড়িয়ে বউকে নিয়ে দরজার দিকে
দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললেন, ‘আমি লোকটা ততটা ভালো না-হলেও খুব একটা খারাপ নই, এফি। চলো, বাড়ি গিয়ে কথা হবে।’
    বাইরে এল হোমস। বোজা গলায় বললে, ‘ওয়াটসন, চলো লন্ডন ফিরি।’


    সারাদিন গুম হয়ে রইল বন্ধুবর। রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে বললে, “যখন দেখবে অহংকারে মটমট করছি অথবা গুরুত্বপূর্ণ কেসে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছি না, মন্ত্র পড়ার মতো ‘নবুরি” নামটা কানে কানে শুনিয়ে দেবে।’

Thanks for visiting my Blog.


কানকাটা রাজার দেশ

কানকাটা রাজার দেশ 
         - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর



এক ছিল রাজা আর তার ছিল এক মস্ত বড়ো দেশ। তার নাম হল কানকাটার দেশ। সেই দেশের সকলেরই কান কাটা। হাতি, ঘোড়া, ছাগল, গরু, মেয়ে, পুরুষ, গরিব, বড়োমানুয সকলেরই কান কাটা। বড়োলোকদের এক কান, মেয়েদের এক কানের আধখানা, আর যত জীবজন্তু গরিব দুঃখীদের দুটি কানই কাটা থাকত। সে দেশে এমন কেউ ছিল না যার মাথায় দুটি আস্ত কান, কেবল সেই কানকাটা দেশের রাজার মাথায় একজোড়া আস্ত কান ছিল। আর সকলেই কেউ লম্বা চুল দিয়ে, কেউ চাপ দাড়ি দিয়ে, কেউ বা বিশ গজ মলমলের পাগড়ি দিয়ে কাটা কান ঢেকে রাখত, কিন্তু সেই রাজা মাথা একেবারে ন্যাড়া করে সেই ন্যাড়া মাথায় জরির তাজ চাপিয়ে গজমোতির বীরবৌলিতে দুখানা কান সাজিয়ে সোনার রাজসিংহাসনে বসে থাকতেন।
     একদিন সেই রাজা এক-কান মন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কানকাটা ঘোড়ায় চেপে শিকারে বার হলেন। শিকার আর কিছুই নয়, কেবল জন্তু জানোয়ারের কান কাটা। রাজ্যের বাইরে এক বন ছিল, সেই বনে কানকাটা দেশের রাজা আর এক-কান মন্ত্রী কান শিকার করে বেড়াতে লাগলেন। এমনি শিকার করতে করতে বেলা যখন অনেক হল, সূর্যদেব মাথার উপর উঠলেন, তখন রাজা আর মন্ত্রী একটা প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় ঘোড়া বেঁধে শুকনো কাঠে আগুন করে যত জীবজন্তুর শিকার করা কান রাঁধতে লাগলেন। মন্ত্রী রাঁধতে লাগলেন আর রাজা খেতে লাগলেন, মন্ত্রীকেও দু-একটা দিতে থাকলেন। এমনি করে দুজনে খাওয়া শেষ করে সেই গাছের তলায় শুয়ে আরাম করছেন, রাজার চোখ বুজে এসেছে, মন্ত্রীর বেশ নাক ডাকছে এমন সময় একটা বীর হনুমান সেই গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে রাজাকে বললে, — রাজা তুই বড়ো দুষ্ট্র, সকলের কান কেটে বেড়াস, আজ সকালে আমার কান কেটেছিস ; তার শাস্তি ভোগ কর। এই বলে রাজার দুই গালে চড় মেরে একটা কান ছিড়ে দিয়ে চলে গেল। রাজা যন্ত্রনায় অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। অনেকক্ষণ পরে যখন জ্ঞান হল, তখন রাজা চারদিক চেয়ে দেখলেন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, হুনুমানটা কোথাও নেই, মন্ত্রীবর পড়ে পড়ে নাক ডাকাচ্ছেন। রাজার এমনি রাগ হল যে তখনি মন্ত্রীর বাকি কানটা এক টানে ছিড়ে দেন; কিন্তু অমনি নিজের কানের কথা মনে পড়ল, রাজা দেখলেন, ছেঁড়া কানটি ধূলায় পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি সেটিকে তুলে নিয়ে সযত্নে পাতায় মুড়ে পকেটে রেখে তাজ টুপির সোনার জরির ঝালর কাটা কানের উপর হেলিয়ে দিলেন যাতে কেউ কান দেখতে না পায়, তারপর মন্ত্রীর পেটে গুতো মেরে বললেন, – ঘোড়া আন। এক গুতোয় মন্ত্রীর নাক ডাকা হঠাৎ বন্ধ হল, আর এক গুতোয় মন্ত্রী লাফিয়ে উঠে রাজার সামনে ঘোড়া হাজির করলেন। রাজা কোন কথা না বলে একটি লাফে ঘোড়ার পিঠে চড়ে একদম ঘোড়া ছূটিয়ে রাজবাড়িতে হাজির। সেখানে তাড়াতাড়ি সহিসের হাতে ঘোড়া দিয়েই একেবারে শয়ন-ঘরে খিল দিয়ে পালঙ্কে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।
     সকাল হয়ে গেল, রাজবাড়ির সকলের ঘুম ভাঙল, রাজা তখনও ঘুমিয়ে আছেন। রাজার নিয়ম ছিল রাজা ঘুমিয়ে থাকতেন, আর নাপিত এসে দাঁড়ি কমিয়ে দিত, সেই নিয়ম মত সকাল বেলা নাপিত এসে দাড়ি কামাতে আরম্ভ করলে। এক গাল কামিয়ে যেই আর এক গাল কামাতে যাবে এমন সময় রাজা ‘দুর্গা দুর্গা’ বলে জেগে উঠলেন। নজর পড়ল নাপিতের দিকে, দেখলেন নাপিত ক্ষুর হাতে হাঁ করে দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ কানে হাত দিয়ে দেখলেন কান নেই। রাজা আপসোসে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে নাপিতের হাতে ধরে বললেন, — নাপিত ভায়া এ কথা প্রকাশ কর না। তোমাকে অনেক ধনরত্ন দেব। নাপিত বললে, কার মাথায় কটা কান যে এ কথা প্রকাশ করব। শুনে রাজা খুশি হলেন। নাপিতের কাছে আর-আধখানা দাড়ি কামিয়ে তাকে দু-হাতে দু-মুঠো মোহর দিয়ে বিদায় করলেন। নাপিত মোহর নিয়ে বিদায় হল বটে কিন্তু তার মন সেই কাটা কানের দিকে পড়ে রইল। কাজে কর্মে ঘুমিয়ে জেগে কী লোকের দাড়ি কাটবার সময়, কী সকালম কী সন্ধ্যা মনে হতে লাগল – রাজার কান কাটা, রাজার কান কাটা ; কিন্তু কারুর কাছে এ কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না – মাথা কাটা যাবে। নাপিত জাত সহজে একটু বেশী কথা কয়, কিন্তু পাছে অন্য কথার সঙ্গে কানের কথা বেরিয়ে পড়ে সেই ভয়ে তার মুখ একেবারে বন্ধ হল। কথা কইতে না পেয়ে পেট ফুলে তার প্রাণ যায় আর কি।
এমন সময় একদিন রাজা নাপিতের কাছে দাড়ি কামিয়ে সোনার কৌটো খুলে কাটা কানটি নেড়ে চেড়ে দেখছেন, আর অমনি কোত্থেকে একটা কাক ফস্‌ করে এসে ছোঁ মেরে রাজার হাত থেকে কানটি নিয়ে উড়ে পালাল। রাজা বললেন – হাঁ হাঁ হাঁ ধরো কাক কান নিয়ে গেল!! রাজা মাথা ঘুরে সেইখানে বসে পড়লেন। ভাবতে লাগলেন, প্রজাদের কাছে কী করে মুখ দেখাব।
     এদিকে নাপিত ক্ষুর ভাঁড় ফেলে দৌড়। পড়ে-তা-মরে এমন দৌড়। শহরের লোক বলতে লাগল – নাপিত ভায়া নাপিত ভায়া হল কী? পাগলের মতো ছুটছ কেন?
     নাপিত না রাম না গঙ্গা কাকের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে একেবারে অজগর বনে গিয়ে হাজির। কাকটা একটা অশ্বখ গাছে বসে আবার উড়ে চলল, কিন্তু নাপিত আর এক পা চলতে পারল না, সেই অশ্বখ গাছের তলায় বসে পড়ে হাঁপাতে লাগল, আর ভাবতে লাগল — ‘এখন কী করি? রাজার কান কাটা ছিল, অনেক কষ্টে সে কথা চেপে রেখেছিলুম ; এখন সেই কান কাকে নিলে এ কথাও যদি আবার চাপতে হয় তাহলে আমার দফা একদম রফা! ফোলা পেট এবারে ফেটে যাবে, এখন করি কী? নাপিত এই কথা ভাবছে এমন সময় গাছ বললে – ‘নাপিত ভায়া ভাবছ কী?
     নাপিত বলল, — ‘রাজার কথা।’
     গাছ বলল – ‘সে কমন?”
     তখন নাপিত চারিদিকে চেয়ে চুপিচুপি বললে –
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা।’
     এই কথা বলতেই নাপিতের ফোলা পেট একেবারে কমে আগেকার মতো হয়ে গেল, বেচারা বড়োই আরাম পেল, এক আরামের নিঃশ্বাস ফেলে মনের ফুর্তিতে রাজবাড়িতে ফিরে চলল।.
     নাপিত চলে গেলে বিদেশী এক ঢুলি সেই গাছের তলায় এল। এসে দেখলে গাছটা যেন আস্তে দুলছে, তার সমস্ত পাতা থারথার করে কাঁপছে, সমস্ত ডাল মড়মড় করছে আর মাঝে মাঝে বলছে— --
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা।’
     ঢুলি ভাবলে এ তো বড়ো মজার গাছ! এরই কাঠ দিয়ে একটা ঢোল তৈরি করি। এই বলে একখানা কুডুল নিয়ে সেই গাছ কাটতে আরম্ভ করলে।
     গাছ বললে – চুলি, ঢুলি আমায় কাটিসনে!
     —আর কাটিসনে! এক-দুই-তিন কোপে একটা ডাল কেটে নিয়ে ঢোল তৈরি করে—‘রাজার কান কাটা, তাই নিলে কাক ব্যাটা’ বাজাতে বাজাতে ঢুলি কানকাটা শহরের দিকে চলে গেল।
     এদিকে কানকাটা শহরে রাজা কান হারিয়ে মলিন মুখে বসে আছেন আর নাপিতকে বলছেন – নাপিত ভায়া এ কথা যেন প্রকাশ না হয়!’ নাপিত বলছে – মহারাজ কার মাথায় দুটো কান যে এ কথা প্রকাশ করবে! এমন সময় রাস্তায় ঢোল বেজে উঠল –
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা।’
     রাজা রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে নাপিতের চুলের মুঠি এক হাতে আর অন্য হাতে খাপ-খোলা তরোয়াল ধরে বললেন– তবে রে পাজি! তুই নাকি এ কথা প্রকাশ করিসনি? শোন দেখি ঢোলে কী বাজছে? নাপিত শুনলে ঢোলে বাজছে—
‘রাজার কানা কাটা
তাই নিলে কাক ব্যাটা।’
নাপিত কঁদিতে কঁদিতে বললে— দোহাই মহারাজ, এ কথা আমি কাউকে বলিনি, কেবল বনের ভিতর গাছকে বলেছি। তানইলে হুজুর পেটটা ফেটে মরে যেতুম!আর আমি মরে গেলে আপনার দাড়ি কে কমিয়ে দিত বলুন?’
     রাজা বললেন— চল ব্যাটা গাছের কাছে বলে নাপিতকে নিয়ে রাজা মুড়িসুড়ি দিয়ে গাছের কাছে গেলেন। নাপিত বললে— ‘গাছ আমি তোমায় কী বলেছি? সত্য কথা বলবে।’
     গাছ বললে –
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা।’
     রাজা বললেন – আর কারো কাছে নাপিত বলেছে কি?’
     গাছ বললে – না।’
     রাজা বললেন – তবে ঢুলি জানলে কেমন করে?
  গাছ বললে – ‘আমার ডাল কেটে ঢুলি ঢোল করেছে। তাই ঢোল বাজছে – ‘রাজার কান কাটা। আমি তাকে অনেকবার ডাল কাটতে বারণ করেছিলাম কিন্তু সে শোনেনি।’
     রাজা বললেন – ‘গাছ, এ দোষ তোমার ; আমি তোমায় কেটে উনুনে পোড়াব।'

গাছ বললে – ‘মহারাজ, এমন কাজ কর না। সেই চুলি আমার ডাল কেটেছে, আমি তাকে শাস্তি দেব। তুমি কাল সকালে তাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে এস।”
     রাজা বললেন – ‘আমার কাটা কানের কথা প্রকাশ হল তার উপায় ? প্রজারা যে আমার রাজত্ব কেড়ে নেবে।’
     গাছ বলে – ‘সে ভয় নেই, আমি কাল তোমার কাটা কান জোড়া দেব। শুনে রাজা খুশি হয়ে রাজ্যে ফিরলেন।
     রাজা ফিরে আসতেই রাজার রানী, রাজার মন্ত্রী, রাজার যত প্রজা রাজাকে ঘিরে বললে – ‘রাজামশাই তোমার কান দেখি।’ রাজা দেখালেন – এক কান কাটা। তখন কেউ বললে, – ‘ছি ছি', কেউ বললে – ‘হায় হায়’। কেউ বললে, — ‘এমন রাজার প্ৰজা হব না। তখন রাজা বললেন, "বাছারা কাল আমার কাটা-কান জোড়া যাবে, তোমরা এখন সেই ঢুলিকে বন্দী কর। কাল সকালে তাকে নিয়ে বনে যে অশ্বখ গাছে তারই তলায় যেও। রাজার কথা শুনে প্রজারা সেই ঢুলিকে বন্দী করবার জন্যে ছুটল।
     তার পরদিন সকালে রাজা মন্ত্রী নাপিত, রাজ্যের প্রজা আর সেই চুলিকে নিয়ে ধুমধাম করে সেই অশ্বত্থতলায় হাজির হলেন। রাজা বললেন,‘অশ্বত্থ ঠাকুর ঢুলির বিচার কর।’
     অশ্বত্থ ঠাকুর নাপিতকে বললেন— নাপিত, ঢুলির একটি কান কেটে রাজার কানে জুড়ে দাও। নাপিত ঢুলির একটি কান কেটে রাজার কানে জুড়ে দিল। চারদিকে ঢাক-ঢোল বেজে উঠল, রাজার কান জোড়া লেগে গেল। এমন সময় যে হনুমান রাজার কান ছিঁড়েছিল সে এসে বললে— অশ্বথ ঠাকুর, বিচার কর— রাজামশায় আমার কান কেটেছে, আমার কান চাই।’
     অশ্বখ বললে, – রাজা ঢুলির অন্য কান কেটে হনুকে দাও। এক কান কাটা থাকলে বেচারির বড়ো অসুবিধা হত— দেশের বাইরে দিয়ে যেতে হত। এইবার ঢুলির দু-কান কাটা হল— সে এখন দেশের ভিতর দিয়ে যেতে পারবে।’
     রাজা এক কোপে ঢুলির আর-এক কান কেটে হনুর কানে জুড়ে দিলেন— আবার ঢাক-ঢোল বেজে উঠল। তখন অশ্বথ ঠাকুর বললে, — ঢুলি এইবার ঢোল বাজা। ঢুলি লজ্জায় ঘাড় হেট করে ঢোল বাজাতে লাগল— ঢোল বাজছে—
ঢুলির কান কাটা।
ঢুলির কান কাটা।
     রাজা ফুল-চন্দনে অশ্বত্থ ঠাকুরের পুজো দিয়ে ঘরে ফিরলেন। রানী রাজার কান দেখে বললেন— ‘একটি কান কিন্তু কালো হল।'
     রাজা বললেন-— তা হোক, কাটা কানের থেকে কালো কান ভালো। নেই মামার চেয়ে কানা-মামা ভালো।’

Thanks for visiting my Blog.


Labels:

রাতের অতিথি

রাতের অতিথি
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়



-- গোপালবাবু যে! শুনলুম কাল রাতে আপনার বাড়িতে চোর এসেছিল!
-- ওঃ সে কী কান্ড মশাই। চোর বলে চোর! সাংঘাতিক চোর!
-- চোর-ডাকাতরই যুগ পড়েছে মশাই। চারদিকে চুরির একেবারে মচ্ছোব পড়ে গেছে। কী চুরি হচ্ছে না বলুন। সোনা- দানা, টাকা পয়সা, বাসনকোসন, জামাকাপড়, এমনকি জুতো, ঝাঁটা, বস্তা, পাপোষ যা পাচ্ছে চেঁছেপুঁছে নিয়ে যাচ্ছে। পরেশবাবুর বাড়িতে যেদিন চুরি হল তার পরদিন তো তাদের লজ্জা নিবারণের বস্ত্রটুকু পর্যন্ত রইল না।
-- তা যা বলেছেন। চোরদের আস্পদ্দা দিন-দিন বাড়ছে।
-- অতি সত্য কথা। নরেনবাবুর বাড়িতে যে চোর এসছিল সে তো রীতিমতো নরেনবাবুকে দু’চার কথা শুনিয়ে যেতে ছাড়েনি। কিপটে, কঞ্জুস, নীচু নজর, রুচিহীন, এমনকি এমন কথা বলে গেছে, আপনার বাড়িতে চুরি করতে এসে যে ভুল করেছি, গঙ্গাস্নান করে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে...
--বটে! এ তো সাংঘাতিক অপমান!
--অপমান বলে অপমান! নরেনবাবু তো সেই থেকে ভারী মনমরা হয়ে পড়েছেন। দু-দিন অন্নজল গ্রহণ করেননি। তবে কিনা বিশ্বকঞ্জুস নরেনবাবু সেই রাত থেকে বেশ দরাজ হয়েছে। এখন দেখছি বাজার থেকে বড় মাছ, ময়রার দোকান থেকে সন্দেশ এসব কিনছেন।
-- তাই নাকি! এই জন্যই সব জিনিসেরই খারাপ আর ভাল দুটো দিক থাকে।
-- তা আপনার বাড়ি থেকে কী কী চুরি গেল?
-- সে সব এখনও হিসেব হয়নি।
--কিন্তু গোপালবাবু, আপনার কব্জিতে রোলেক্স হাতঘড়িটা এখনও দেখতে পাচ্ছি যে! ব্যাপারটা কী? চোর কি ওটা দামি ঘড়ি বলে বুঝতে পারেনি?
--পারেনি মানে! ঘড়িটা একটানে খুলে নিয়ে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে কত সালের কোন মডেল, কত দাম সব গড়গড় করে বলে গেল মশাই।



-- তাজ্জব কথা! তবু নেয়নি?
-- না। ঘড়িটা তাচ্ছিল্যে সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, এ ঘড়ির এখন অনেক দাম। সাবধানে রাখবেন।
-- বলেন কী? কলিযুগ কি শেষ হয়ে গেল নাকি মশাই? তারপর ধরুন, আপনার স্ত্রীর গলায় একটা পনেরো ভরির সীতাহারের কথা  যেন শুনেছি। সবাই বলে দামি হার নাকি। তা সেটা নিশ্চয়ই গেছে।
--উঁহু। সীতাহারটা তো ছুঁলই না। দূর থেকেই বলে দিল চৌদ্দ ভরি আট রতি মাপা আছে। এখনকার বাজার দর নাকি দেড়লাখ টাকার উপরে।
-- সেটাও নেয়নি! সে আবার কেমনধারা চোর? আপনার লোহার আলমারি খোলেনি?
--খুলেছে বইকি। চোর বলে কথা! খুলল, দেখল।
-- ওই আলমারিতে তো বোধ হয় ...
-- ঠিকই ধরেছেন। আমার সব ক্যাশ টাকা ওই আলমারিতেই থাকে। আজ লেবার পেমেন্টের জন্য আড়াই লাখ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনে ওই আলমারিতেই রেখেছিলাম। টাকাগুলো বের করে গুনেটুনে দেখলও।
-- তারপর থলিতে ভরল তো!
-- হ্যাঁ, থলিও তার সঙ্গে একটা ছিল বটে। রুকস্যাকের মতো একটা ব্যাগ। ভরার উপক্রম একবার করেছিল। তারপর নিজের মনে ‘না থাক’ বলে যেমন ছিল তেমনি আবার আলমারিতে সাজিয়ে রেখে দিল।
-- আড়াই লাখ টাকা! চোর আড়াই লাখ টাকা হাতে পেয়েও নিল না মশাই! এ্যাঃ, আমারই তো হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আপনার দুবাই না তেহরান থেকে আনা হীরের কালেকশনটা? লোকে তো বলে পূর্ব ভারতে আপনার মতো হীরের কালেকশন কারও কাছে নেই।
-- ঠিকই বলে। আমি বহুকাল ধরেই হীরে কালেকশন করে আসছি, ওটাই আমার নেশা। রেয়ার সব হীরে মশাই। লাখ লাখ টাকা দাম।
-- তা সেসব কি ছাড়তে পারে?
-- ছাড়েওনি। আমাকে দিয়ে জোর করিয়ে সিন্দুক খুলিয়ে সব আঁতিপাঁতি করে দেখেছে। দেড়শো হীড়ে ছাড়াও নাোন সাইজের মুক্তে, নীলা, পোখরাজ, চুনি, গোমেদ মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকার পাথর।
-- আহা, শুনেই আমার পিলে চমকাচ্ছে। তা গেল তো সেগুলো! যাবেই। অত দামি জিনিস কি বাড়িতে রাখতে আছে মশাই? ব্যাঙ্কের ভল্টে বা মাটির নীচে পুঁতেটুঁতে রাখতে হয়।
-- তা বটে। সে রকম একটা ফন্দি মনে-মনে ঠিকও করে রেখেছি। কিন্তু সেটা কার্যকর করার আগেই কাল মধ্যরাতে চোরের আবির্ভাব।
-- জানালা ভেঙে ঢুকল বুঝি?
-- না, অতি ঘোড়েল চোর। ভাঙচুর করলে তো শব্দ শুনতে পেতাম। আমার আবার ভারী সজাগ ঘুম। বাড়ির দেউড়িতে দারোয়ান আছে, দুটো অ্যালসেশিয়ান কুকুর, টোটাভরতি বন্দুক আছে, বালিশের তলায় পিস্তল নিয়ে শুই। সুতরাং মোটামুটি নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিশ্ছিদ্রই বলা যায়।
-- হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার বাড়িটা তো দুর্গ বিশেষ। কুকুরদুটো খুবই তেজী। দারোয়ান দুটোও বেশ তগড়াই চেহারার বটে। তাহলে চোরটা ঢুকল কীভাবে বলুন তো!

--সেটাই রহস্য। আমি চোরটাকে জিগ্যেসও করেছিলুম, বাপু হে, এ বাড়িতে ঢোকা তো সহজ নয়। তুমি ঢুকলে কি করে?
-- জবাবে কী বলল?
-- বলল, দুনিয়ায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। সব জায়গাতেই ঢোকা সম্ভব। আমি আপনার বাড়ির সামনের তেঁতুল গাছ থেকে হুক সমেত একটা নাইলন ছুড়ে ছাদের রেলিঙে আটকে দিয়ে সেইটে বেয়ে ছাদে এসে নামি।
--  এ তো দেখছি টারজান!
-- তা বলতে পারেন। দিব্যি কসরত করা চেহারা। ভদ্রঘরের ছেলের মতোই মনে হয়।
-- দিনকাল যা পড়েছে, ভদ্রঘরের বেকার ছেলেদেরও এইসব পথেই নামতে হচ্ছে। তা তারপর কী হল?
-- চোরেরা নিঃশ্চুপ চুরি করে সেটাই রেওয়াজ। কিন্তু এর কায়দা আলাদা। খুব মোলায়েম গলায় আমার নাম ধরে ডেকে ঘুম ভাঙাল।
-- নাম ধরে? ছিঃ ছিঃ, আপনি বয়স্ক মা্নুষ।
-- না, সে আমাকে গোপালকাকা বলে ডেকেছিল।
-- বাঁচোয়া। তারপর বলুন।
-- আমি পিস্তল খুঁজতে গিয়ে দেখি, সেটা যথাস্থানে নেই। চোরটা বলল, অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে নিয়েছি।। আলমারি সিন্দুক সব খুলুন। সময় নেই।
-- ওরে বাবা! এ তো চোরের বেশে ডাকাত!
-- তাও বলতে পারেন। সব দেখল। টাকা পয়সা, হীরে জহরত, সোনাদানা, কিন্তু কোনটাই তার যেন পছন্দ হচ্ছিল না। হীরেজহরতগুলো একটু নাড়াচাড়া করল বটে, কিন্তু যেন তেমন গা করল না।


-- এ কেমন বেয়াদব চোর মশাই। এত কসরত করে ঢুকল, সব হাতের নাগালে পেল তাও তার গাল উঠল না কেন?
-- সেইটেই রহস্য। সব দেখেশুনে বলল, আপনার আর কোনও দামি জিনিস নেই? আমি অবাক হয়ে বললাম, এর চেয়ে দামি জিনিস আর কী থাকবে? চোরটা মুখ বেঁকিযে বলল, ‘হ্যাঁ, এসব জিনিস বটে, কিন্তু আমার দরকার লাগবে না।
-- বটে! খুব নবাবপুত্তুর দেখছি। তারপর?
-- তারপর সে বলল, আপনার বইপত্র কোথায় থাকে? আমি বললুম, নীচের লাইব্রেরী ঘরে।
-- বইপত্র! ছোঃ বইপত্র দিয়ে কী হবে?
--সেইটে তো জানি না। তবে নিয়ে তে হল। দেখলাম বইপত্রে তার বেশ আগ্রহ। বিস্তর বই বের করে করে দেখল, আবার যত্ন করে জায়গায় রেখে দিল। অনেকক্ষণ ধরে প্রতিটি আলমারি ঘাঁটল সে।
-- বই ঘেঁটে সময় নষ্ট করা কেন বাপু?
-- আমিও সেই কাথাই বলেছিলুম। সে বলল, ও আপনি বুঝবেন না।
-- তারপর?
-- বললে বিশ্বাস করবেন না, খুঁজে খুঁজে সে একখানা বই বের করল। বেশ পুরনো বই। নাম নীলবসনা সুন্দরী। কার লেখা জানি না। বইপত্র পড়ার অভ্যাস আমার নেই। বাপ-দাদার আমল থেকেই ওগুলো পড়ে আছে।
-- নীলবাসনা সুন্দরী! তা সেটা কী করল?
-- সেটাই চুরি করল মশাই। বলল, এটা চুরি করতেই আমার আসা।
-- শুধু একটা বই?
-- হ্যাঁ। বইটা নিয়ে সে হাওয়া হয়ে গেল মশাই!
-- আশ্চর্য! এরকম আহাম্মক আর দেখিনি!

- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

Thanks for visiting my Blog.


Labels:

Monday, 21 May 2018

প্লাস প্রেম আর ফ্লাইং কিস

প্লাস প্রেম আর ফ্লাইং কিস
              -তন্ময় চট্টোপাধ্যায়


সিঁড়ি ভাঙ্গা অঙ্কের দিন শেষ হয়ে গেছে। সিলেবাসে নতুন আর এক গনিত। “পাটি”র পাশে পাটি পেড়ে এসে বসেছে বীজগনিত। মাছের ল্যাজা আর মুড়ো ফ্যাক্টর হয়ে উঠে এসেছে অঙ্কের পাতায়। অঙ্কের বাঁদরও বেজায় ভোগাচ্ছে। উঠছে আর পড়ছে। বিজ্ঞানও ভেঙে দুভাগ। যেন চমকের পরে চমক

সিলেবাসের চমক ধীরে ধীরে জীবনেও এসে লাগে। বয়স লাগে গলায়। ঠোঁটের ওপর গোঁফের রেখা। দৃষ্টিতে হাল্কা দূষণ। মনে খুচরো পাপবোধের কুচুরমুচুর। ভেতরে এন্ডোক্রিনের কলকাঠি। বন্ধুদের গোপন বৈঠক। সেখানে লিলি মিলি পলিদের নিত্য নতুন টাটকা সব খবর।


জীবনে এই হল তুমি – আমি মার্কা প্রেমের খুঁটিপুজোর সময়। মন জমি প্রস্তত। এবার শুধু বীজ পুঁতলেই চলবে। জীবনের এই রোমাণ্টিক ধাপে ইস্কুল নিতান্তই বেমানান এক পরিবেশ। প্রেমিকের চারপাশে অসহযোগ। অনেকটা ব্রিটিশ যুগে স্বদেশী করার মতই তার দূরবস্থা।
বছর ত্রিশ আগের এক ঘটনা মনে পড়ছে। স্থান গ্রাম্য এক কো-এড ইস্কুল। নাইনের স্বপন তখন সদ্য ভালোবেসে ফেলেছে সীমাকে। একতরফা ভালোবাসা। স্বপনের হার্টে ধুকপুক। সীমা কিন্তু ঘোর অন্ধকারে। ভেবেচিন্তে স্বপন দেখলে এ চাপ যেন আর নেওয়া যায় না। তুলতে হবে, যেভাবে হোক সীমার কানে তুলতে হবে কথাটা। তার পর যা থাকে কপালে।

কিন্তু তুলবে কে? হু উইল বেল দি ক্যাট? বন্ধুরা পরামর্শ দিলে, দেওয়ালে লিখে দে স্বপন। নতুন চুনকাম করা ইস্কুলের দেওয়াল, প্লাস দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লিখে দে, বেশ খুলবে। আইডিয়াটা বেশ মনে ধরল স্বপনের। তবে নিজের হাতে লেখা? – ওরেব্বাবা, সেকথা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিল স্বপনের। অগত্যা উপায় বলতে বিশু। সেসময়ে ইস্কুলের নামকরা কাঠকয়লা শিল্পী ছিল সে। চমৎকার হাতের লেখা। আর তেমনি ডাকাবুকো। অনেক কচি নায়ক-নায়িকাকে প্লাস দিয়ে ইস্কুলের দেওয়ালে তুলেছে সে। তবে স্বভাবে বিশু ছিল বড্ড পেশাদার। একটা হাফ পাউন্ড স্লাইস ব্রেড আর এক প্লেট ঘুগনি ছাড়া লেখার কাজ হাতে নিত না সে। স্বপন বিশুকেই ধরল তবে একটু দরাদরি করতেও ছাড়ল না। বলল, “শুধু ঘুগনিটাই থাক না ভাই, আবার পাউরুটি কেন? পেশাদারের মতই গুছিয়ে উত্তর দিল বিশু। বলল, “শুধু ঘুগনিতে কী আর হ্য় বল? আমার রিস্কটা একবার ভেবে দেখ। কতরকম কায়দায় এক একটা অক্ষর লিখতে হয় বলত? হাতের লেখা মিলিয়ে সুপ্রিয় স্যার যদি একবার ধরে তাহলে আর রক্ষে রাখবে? টি সি তো বাঁধা। পাউরুটি স্যাক্রিফাইস করতে পারব না ভাই। তবে হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি, একটা স্পেশ্যাল কায়দায় লিখব তোদের নাম। প্লাস না লিখে দুটো নামের মাঝে তীর বেঁধা বড়সড় একটা হার্ট এঁকে দেব। দেখবি কেমন জমবে!

শুরুতেই অসহযোগ। পকেট পাংচার। তবু পেশাদার ধরে লাভই হল স্বপনের। হয়ত বিশুর লেখার গুনেই গলে গেল সীমা। ভাগ্যটাও সাথ দিল। ইস্কুলে তিনটে স্বপন, চারটে সীমা। কাজেই দেওয়াল লিপির লেখককে ধরতে শার্লক স্যারেরা আর ইনভেস্টিগেশনের পথে গেলেন না।
প্লাস দিয়ে দেওয়ালে নাম তোলার অর্থ হল খবরটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া। এটা ছিল সেকালের ইস্কুলের ভালোবাসার প্রথম ধাপ। এরপর কচি প্রেমিক নজরে রাখত তার মনের মানুষটিকে। মুচকি হাসি, চোখাচোখির মত খুটিনাটিগুলো মনোমত হলে তবেই সে এগিয়ে যেত দ্বিতীয় ধাপের দিকে। চিঠি লেখা দিয়ে শুরু হত এই ধাপের কাজকম্ম।
প্রেমের চিঠি – সেও ছিল এক সূক্ষ্ম শিল্প কর্ম। কিন্ত ক’জনই বা সে আর্ট জানত? আমাদের এলাকার টুকলিবাজ ছেলে হারু তখন নামকরা প্রেমপত্র লেখক হয়েছিল। টুকলি করে করে হাত এতটাই পাকিয়েছিল যে ছোট তিন ইঞ্চি বাই তিন ইঞ্চি কাগজে সে প্রায় হাজার শব্দ ধরাতে পারত। তাকে দিয়ে চিঠি লেখানোর একটা আলাদা সুবিধে ছিল। সুবিধেটা এই যে সে চিঠি ধরা পড়লেও স্যরেরা তার পাঠোদ্ধার করতে পারতেন না। আতস কাচের নীচে রেখে সে চিঠি নাকি পড়তে হত। তাই আনকোরা প্রেমিকরা তাদের প্রেমপত্র লেখার জন্য ভিড় করত হারুর কাছে। হারু ছিল আর এক পেশাদার। চিঠিপ্রতি তার ফি ছিল আট আনা। সেকালের হিসেবে বেশ মহার্ঘ।
মিষ্টি চিঠিতে টুকটাক ডেকরেশন। তার পর তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া। কিণ্তু সে তো আর এক দুরূহ কাজ। এ নবাব বাদশার চিঠি নয়। পত্রবাহক কবুতরও নেই। তাই চিঠি পকেটে নিয়ে ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়াত প্রেমিক। কখন সুযোগ আসে তারই অপেক্ষা। চারদিকে জ্যান্ত সি সি টি ভি’র মত মাস্টারমশাই। অবশেষে কোনো একদিন সুযোগ যখন শিকে ছিঁড়ত তখন দেখা যেত যে সে চিঠি আর চিঠি নেই। পকেটের মাল পত্রের চাপে  আর হাতের পেশাইয়ে পড়ে সে তখন কাগজের এক দলাইমলাই। ইস্কুলে সেরকম ন্যাতানো চিঠি ধরা পড়লে কাপড়ের তলায় রেখে তাকে ইস্ত্রি করে আনতেন আমাদের ইস্কুলের নন টিচিং স্টাফ অধীরদা। তারপর ইস্ত্রি খাওয়া কড়কড়ে প্রেমের চিঠি হাতে গবেষনায়  বসতেন  শার্লক স্যারেরা। হারুর চিঠির পাঠোদ্ধারের কৌশল স্যারেদের জানা ছিল না। তবে বড়সড় অক্ষরের চিঠির লেখকরা ছিল বেশ দুর্ভাগা। তাদের ভাগ্যে জুটত চড়-চাপাটি। টি সি লেখার কাজে করনিকের জড়তা ছিল না।
সেবার এক অদ্ভুত চিঠি ধরা পড়ল আমাদের ইস্কুলে। ছোট্ট চিঠি। “আমি তোমার প্রেম – বৃক্ষে বাঁধা এক ছাগল। মাঝে মাঝে ভালোবেসে যে পাতা তুমি ফেল তাই চিবোই আর ব্যা ব্যা করি।
হু ইজ দ্যাট গোট?” হেডস্যার গর্জে উঠলেন। অনেক অনুসন্ধান চলল। কিন্ত ছাগলের সন্ধান পাওয়া গেল না। আমরা জানতাম এ চিঠি অজয়ের লেখা। মধুমিতা আর অজয় ভালোবেসে পরস্পরকে ছোট ছোট নামে ডাকত। অজয় ডাকত মধু, আর মধু ডাকত অজা। বন্ধুমহলের সে কথা স্যারেদের কানে আর উঠল না। তাই অজার ব্যা ব্যা করার গল্প তাদের অজানাই থেকে গেল।
চিঠির ব্যাপারে বেশ ডাকাবুকো ছিল আমাদের ক্লাসের দুই মাতব্বর – হাবু আর রাধারমণ। পড়াশোনায় দুজনেরই ট্র্যাক রেকর্ড বেজায় খারাপ। দুজনেই থেবড়ে নাইনে বসে আছে তিন বছর ধরে। বাংলার বেহাল দশা। বাংলায় ভালো নম্বর পাই বলে তাদের চিঠির প্রুফ সংশোধনের দায়িত্ব মাঝে মধ্যে এসে পড়ত আমার ওপর।              
চারদিকে মার্জিন দেওয়া ফুলস্কেপ কাগজে চিঠি লিখত হাবু। একেবারে উত্তর পত্রের মত। ওপরে ওঁ গণেশায় নমঃ। প্রথম বার ভুল করে “শ্রী চরণেষু সোনালী” লিখে ফেলেছিল। তারপর থেকে “সুইট সোনালী” লিখত। আইডিয়াটা নাকি এলাকার নামকরা মিষ্টির দোকান “সোনালী সুইটস” থেকে ধার করা। চিঠির শেষে পুনশ্চ দিয়ে হাবু লিখত “তোমার জন্য ফ্লাইং কিস।”  তার নীচে তীরবিদ্ধ বড়সড় হার্ট। রক্তক্ষরণের ছবি। হাতের লেখাটা মন্দ ছিল না। তবে ভাষার ব্যবহার ছিল বেশ গোলমেলে। “সরস্বতী পুজোর দিন শাড়িতে তোমাকে বিউটি লাগছিল” – এই বাক্যে ভুলটা ঠিক যে কোথায় তা তাকে বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হত।
রাধারমণের প্রথম দিকের চিঠি ছিল বেশ কাব্যময়। প্রতি চিঠিতে স্বরচিত বা ধার করা অন্ততঃ গোটা চার অণু বা পরমাণু কবিতা লিখত সে – আকাশ জুড়ে নীলের বাসা/তোমার হাসি দেখতে খাসা। কিংবা, মিষ্টি সুরে কোকিল গায়/ মন তোমাকে দেখতে চায়। রাধা গদ্যে ফিরল বিশেষ এক ঘটনার পরে। তৃতীয় বার নাইনে দেহ রাখার পরে মিতালি রাধাকে “গাধা” বলেছিল। তারপর বেশ কিছুদিন চিঠিপত্র বন্ধ। প্রেম যায় যায় অবস্থা। অবশেষে রক্ত দিয়ে চিঠি লিখল রাধা। রক্ত নিজের নয়। হাজির রেওয়াজি খাসির রক্ত। সেই চিঠি পড়ে মিতালি ডেটল পাঠাল গিফট হিসেবে। থেমে গেল মনকষাকষি।

এই দুই মাতব্বরের ভালবাসা নিয়ে স্যারেরা অবশ্য সেভাবে মাথা ঘামাতেন না। কারণ এদের প্রেমিকারা ক্লাসের নিরিখে ছিলেন এদের দিদি স্থানীয়া। সরস্বতী পুজোর মত দিনে তাই এরা দিব্যি দোর দিয়ে গল্প করত “দিদি” দের সাথে। কিন্ত “বোন”দের সাথে সেরকম গল্পের সুযোগ অনেকেই পেত না। সেই সব অভাগার আপশোশের কথা মা সরস্বতী নিশ্চয়ই টের পেতেন।
সে সব দিন আর নেই, নেই সেইসব আপশোষের ফোঁস ফোঁস। কালের ম্যাজিকে বদলে গেছে অনেক কিছুই। প্লাস-প্রেম মাইনাস হয়ে গেছে ইস্কুলের জীবন থেকে। ইস্কুলের দেওয়ালে পরিচ্ছন্নতা। কাঠকয়লা শিল্পীরাও উধাও। লিলিপুট-লিপি-শিল্পীরা নেই, নেই পত্রবাহক, নেই সেই লক্ষ ভাঁজে ভাঁজ হওয়া চিঠি। প্রেম তবু আজও মিষ্টিই আছে। মোবাইল জামানায় প্রেমিক-প্রেমিকা আরো কাছাকাছি। ভ্যানিশ হয়েছে তুমি-আমি – সবাই এখন “তুই”। মিনিটে  মিনিটে প্রেমের আপডেট আসছে মোবাইলে। ফ্লাইং কিস নয়, ভেসে আসছে টকটকে লিপস্টিক দেওয়া টাটকা ঠোঁটের ছবি। শার্লক স্যারেরা আজো আছেন। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে তাঁরা আজো টের পান প্রেমরোগীদের অস্তিত্ব। তবে প্রেমের ভূত তাড়াতে সেভাবে আর তেড়েফুঁড়ে ওঠেন না। প্রেমিকের মোবাইল বাজেয়াপ্ত করেও পাসওয়ার্ডের অভাবে কেমন যেন ভ্যাবলা হয়ে যান। শিক্ষার অধিকার আইন এসেছে। টি সি গেছে জাদুঘরে। এ কালের কচিকাঁচাদের প্রেমে তাই সেই ভয়ানক অসহযোগ আর নেই।



Thanks for visiting my Blog.

Next stories coming soon.

Keep with me.